স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা ছিলো প্রায় ৫ লাখ। গত বছর নভেম্বরে আরও প্রায় ৭৪ হাজার মানুষ মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ করে।[1] গেল আগস্ট মাস থেকে এখানে যোগ হয়েছে আরও প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী।[2] বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুসারে কম করে হলেও প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বর্তমানে বাংলাদেশের আশ্রয়ে আছে। যা অন্য যে কোন রাষ্ট্রের তুলনায় সর্বাধিক।

Credit: Al Jazeera
হ্যাঁ, অবশ্যই বাংলাদেশ সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে এত উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিচ্ছে না। সেটি বাংলাদেশ কেন অন্য যে কোন দেশেও দিতে সক্ষম নয়। সময় সময় বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থানের অনুদান ও সহযোগিতার মাধ্যমেই এই কাজটি করছে বাংলাদেশ ও ইউএন।
আর এসব তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের থাকার জন্য বাংলাদেশ নিজের স্থান প্রদান করার মাধ্যমে যা করছেন তা হলো, ১) এতগুলো শরণার্থীদের নিরাপত্তা দিচ্ছে, ২) বিভিন্ন পক্ষ থেকে আসা সম্ভাব্য হুমকির দায়ভার নিচ্ছে, ৩) শরণার্থীদের সাথে আসা দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে সহিংসতা ঘটার ঝুঁকি নিচ্ছে, ৪) অতালিকাভুক্ত শরণার্থীদের ভার নিতে হচ্ছে সম্পূর্ণ এদেশের, ৪) এই শরণার্থীদের খুব শীঘ্রই মিয়ানমার ফিরিয়ে নেবে না তা জেনেও আরও শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে, যা ভবিষ্যতে এদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকির কারণ হতে পারে। অথচ সম্পূর্ণ ঘটনায় নায়ক সাজছে কারা? অবশ্যই আপনি না। অথবা বাংলাদেশের সরকার না।
গত বছরের অক্টোবরের রোহিঙ্গা বিপর্যয় থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ায় এক গোষ্ঠী প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বা তার তুরস্ককে বরাবর নায়ক বানাতে চাচ্ছে। কখনো বলা হচ্ছে মিয়ানমারকে কঠোর হুমকি-ধমকি দিয়েছেন তিনি, কখনো বা বলা হয়েছে তুরস্কে থাকা বৌদ্ধদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, কখনো বা বলা হচ্ছে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দিচ্ছে তুরস্ক অথচ এসবের সবগুলো দাবীই ছিলো মিথ্যা ও কল্পনাপ্রসূত। তা আপনারা জানেন, ইতিমধ্যে দেখছেন। গলাবাজিতে তুরস্ক সরকার নিজেরাও পিছিয়ে নেই। সেদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ক’দিন আগে বলেছেন, “বাংলাদেশ তোমরা সীমানা খুলে দাও, তুরস্ক রোহিঙ্গাদের ব্যয় বহন করবে।”[3] এই গলাবাজি প্রচারিত হয়েছে সারা বিশ্বব্যাপী। আমাদের দেশের অনেকেই তাতে বাহবা দিয়েছে। তুরস্ক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও ফার্স্ট ল্যাডি সেপ্টেম্বর ৭ তারিখে দেশে আসেন, প্রায় ১ হাজার টন ত্রাণ নিয়ে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনেও গিয়েছেন তারা। এই খবর ফলাও ভাবে বাংলাদেশের মিডিয়া তো বটেই তুরস্ক মিডিয়াও সর্বাত্মক ভাবে প্রচার করেছে। বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়াতে স্পন্সর করেও সংবাদ প্রচার করেছে তুরস্ক। প্রথম পর্যায়ের ১ হাজার টন ত্রাণ বাংলাদেশে আসে নি। গিয়েছে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে।[4] দ্বিতীয় পর্যায় আরও ১০ হাজার টন ত্রাণ আসবে বলে তুরস্ক জানিয়েছে। তবে সেটি কেবল বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্যই কিনা তা স্পষ্ট না।
“তুরস্ক রোহিঙ্গাদের ব্যয় বহন করবে”-কথাটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। আমাদের দেশের মানুষসহ সারা বিশ্বের করতালি পেয়েছে তুরস্ক। তুরস্ক সফল। অনেকে তো ধরেই নিয়েছে তুরস্কের আশ্বাসে বাংলাদেশ তার সীমানা খুলে দিয়েছে। যেন এত বছর ধরে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়ে আসে নি। ১০ হাজার টন ত্রাণ ঠিক কত পরিমাণ হয় তা আমরা অনেকেই জানিনা বলে ধরে নিচ্ছি তুরস্ক তো সব ব্যয়ভার নিয়েই নিয়েছে। সম্প্রতি নতুন আসা শরণার্থীদের জন্য ইউএন ও অন্যান্য এজেন্সিগুলোর অতিশীঘ্রই প্রয়োজন প্রায় ৭৭ মিলিয়ন ডলার।[6] জানামতে, তুরস্কও এই অনুদান এখনো পর্যন্ত দেয় নি বা দিবে বলে আশ্বস্ত করে নি।
রোহিঙ্গা ইস্যু গণমাধ্যমগুলোতে আসার পর সৌদি আরবের ভূমিকা নিয়ে অনেকেই আঙ্গুল তুলেছে। আর তাই তুরস্ক তোষামোদকারী গোষ্ঠীর মত, সৌদির ভূমিকা তুলে ধরতে আরেক গোষ্ঠী উঠে পরে লেগেছে। দাবী করা হচ্ছে সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা বিপর্যয়ে সৌদির বাদশাহ সালমান ৫০০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিচ্ছে। এছাড়াও বলা হচ্ছে সৌদিতে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে। দাবী দুইটিই ভিত্তিহীন। অপরদিকে একাধিক সংবাদ সূত্রে জানা যায়, সৌদিতে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকেই মিয়ানমারের ‘আরসা’ জঙ্গি সংস্থা পরিচালনা করা হয়।[7] যেই জঙ্গি সংস্থার নাম ভাঙ্গিয়ে মিয়ানমার নিরীহ সাধারণ রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন করছে।
সম্ভবত ধনী দেশ ও গরিব দেশের মধ্যে অন্যতম পার্থক্য হচ্ছে, ধনী দেশগুলো ১০টি পয়সা অনুদান প্রদান করলেও তা ঢাকঢোল পিটিয়ে বেড়ায় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোও তাতে উদারতার রসদ মাখতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করে না। অপর দিকে গরিব দেশগুলো সবসময়ই নিজেদের ছোটভাবে। তাই নিজেদের ভূমিকাগুলো ছোট করে দেখে। আর মিডিয়াও সংবাদ পরিবেশন করে ঠিক সেইভাবে।
যখন বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধিকে নিয়ে কানাডার ৪ কোটি মানুষের প্রতিনিধি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করে, আমরা বাংলাদেশীরা মনে করি আমাদের জীবন ধন্য করে ফেলা হয়েছে। কানাডা বিবিধ ধরণের যাচাই-বাছাই করে সিরিয়ার ৭০-৮০ হাজার শরণার্থীদের যখন নিজের দেশে স্থান দেয় তা দেখানো হয় মহান উদারতা হিসেবে। অথচ যখন বাংলাদেশ পুরো সীমানা অরক্ষিত রেখে তার তিনগুণেরও বেশী শরণার্থী, যাদের কোনপ্রকার পরিচয়পত্র নেই, তাদের ঢুকতে দেয়, তখন বাংলাদেশের ভূমিকা প্রায় উহ্য করেই দেখা হয়। যখন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি রোহিঙ্গাদের জড়িয়ে ধরে কাঁদে, সবাই আবেগে আপ্লুত হয়ে যায়। অথচ যখন এদেশের মানুষ নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী দৌড়ে দৌড়ে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে, তখন সেটি আমরা নিজেরাই নগণ্য ধরে নিচ্ছি। রাশিয়া, যেই দেশ সিরিয়া গণহত্যায় সরাসরি সহযোগিতা করছে আসাদ সরকারকে, সেই দেশের জনতা রোহিঙ্গাদের জন্য রাস্তায় নেমে সংহতি জানালে আমরা আবেগ আর ধরে রাখতে পারি না। অথচ এতগুলো বছর ধরে এদেশের সাধারণ মানুষ দফায় দফায় রাস্তায় নেমেছে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরোধিতা করতে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ৬ হাজার কিলোমিটার দূরে বসে যখন গলাবাজি করছেন, তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশের সার্বভৌমত্বের ঝুঁকি নিয়ে সীমানা খুলে দিচ্ছে। অথচ আমরা গাইছি এরদোয়ানের জয়জয়কার। হচ্ছি নতজানু। বানাচ্ছি তাকে মুসলিম জাহানের সুলতান।
অসংখ্য ফেইক প্রোফাইল ও গুজব ভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ থেকে তুরস্কের এত জয়গান গাওয়ার পেছনের সুর কি? ধর্মের ভাইদের প্রতি উদারতা? নির্যাতিতদের প্রতি সমবেদনা? না! পেছনের সুর খুবই সোজাসাপ্টা রাজনীতি। এটি স্পষ্ট ক্ষমতার লড়াই। তাইপ এরদোয়ান প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে চেষ্টা করছেন মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে তুরস্ককে প্রতিষ্ঠা করতে। ওটোমান সাম্রাজ্যের সমাপ্তির পর যে স্থানটি সৌদি আরব দীর্ঘকাল ধরে রেখেছে। আর এটিকে বাংলাদেশে মদদ দিচ্ছে কিছু গোষ্ঠী যাতে করে এরদোয়ান সফল হলে তারাও তাদের স্বস্ব স্থান অধিকার করতে পারে। ফিলিস্তিনের মজলুমদের দেখিয়ে রাজনীতি শেষে, এখন এসব রাজনীতিবিদরা রোহিঙ্গা নির্যাতিতদের নাম ভাঙ্গাচ্ছে মাত্র।
তুরস্ক কিংবা সৌদি আরবকে এত মান্যবর হিসেবে দেখার কিছু নেই। সাম্প্রতিক দূর্যোগে এগিয়ে এসেছে মালেশিয়া, ডেনমার্কসহ আরও অনেক দেশ। পাশাপাশি বাংলাদেশের সাধারণ জনগণও।
বাংলাদেশীদের নিজেদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে শেখা উচিৎ। নিজেদের নিয়ে সবসময় নেতিবাচক ধারণা পোষণ করি বলেই, আমরা নিজেদের মধ্যে কেবল খারাপ জিনিসগুলো দেখতে পাই। দুর্বলের প্রতি উদারতা কিংবা অসাম্প্রদায়িক চেতনা – এসব অন্য দেশের কাছে নতুন হলেও বাংলাদেশ এসব চর্চা করে আসছে জন্মলগ্ন থেকেই।
সদ্য বন্যাকবলীত একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হয়েও আড়াই লক্ষাধিক শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার মত দুঃসাহস কেবল বাংলাদেশরই আছে। ৩ লাখ বিহারীকে নিজের দেশের নাগরিকত্ব দেওয়ার মত উদারতা বাংলাদেশই দেখাতে পারে।
বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যাকে নিয়ে আমরা আরও বেশি গর্ব করতে পারি, যতটুকু না আমরা করি।
অনলাইনে চলমান বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আপনার গঠনমূলক পর্যবেক্ষন কিংবা অভিমত আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবো। আমাদের পাঠাতে হবে contact[at]jaachai.com-এই ঠিকানায়। অথবা আমাদের ফেইসবুক পেইজে সরাসরি পাঠিয়ে দিতে পারেন।
অনলাইনে চলমান বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আপনার গঠনমূলক পর্যবেক্ষন কিংবা অভিমত আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবো। আমাদের পাঠাতে হবে [email protected]এই ঠিকানায়। অথবা যাচাই-এর ফেসবুক পেইজ-এ সরাসরি পাঠিয়ে দিতে পারেন।