কিছুদিন আগে নকল ডিমের আতঙ্কে আক্রান্ত বাংলাদেশের বর্তমান শঙ্কার নাম ‘ব্লু হোয়েল’ বা ‘নীল তিমি’। বেশ কিছু মাস ধরে অনলাইনে চলমান এই বিষয়ক গুজবটি খুব একটা মনোযোগ আকর্ষণ করতে না পারলেও, অবশেষে ঢাকায় অপূর্বা বর্মণ স্বর্ণা নামের ১৩ বছরের এক কিশোরীর মৃত্যুর মাধ্যমে সবার আলোচনা ও কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হয় ‘ব্লু হোয়েল গেম’।
বলার অপেক্ষা রাখে না কোন প্রকার তদন্তেই অপূর্বার মৃত্যুর সাথে ব্লু হোয়েল গেমের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় নি। এই তথাকথিত গেমের মাধ্যমে তার মৃত্যুর দাবীটি উঠে আসে যখন এক সাক্ষাৎকারে অপূর্বার পিতা ব্লু হোয়েল খেলার ফলে তার কন্যার মৃত্যু হতে পারে – এমন একটি সন্দেহ প্রকাশ করে। অপূর্বার পিতা সন্দেহের পেছনে রয়েছে অনলাইনে পড়া বিভিন্ন আর্টিকেল ও ভিডিও। শুধুমাত্র তার এই সন্দেহের উপর ভিত্তি করে এটিকে সংবাদ হিসেবে প্রচার শুরু করে দেশের শীর্ষ গণমাধ্যমগুলোসহ অসংখ্য বেনামি নিউজ পোর্টাল।
মিডিয়ার এত হৈচৈ এর ফলাফলে গুজবটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সরকারেরও। বাংলাদেশে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিটিআরসিকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশও দেওয়া হয়। অথচ ব্লু হোয়েল গেম ঠিক নকল ডিমের দাবীর মতই সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন একটি দাবী। নকল ডিম যেমন কেউ কখনো দেখে নি বা কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণ করতে পারি নি, ঠিক তেমনি ব্লু হোয়েলের মত ‘অতি উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভর’ কিংবা ‘আত্মহত্যায় বাধ্য করে’ এমন কোন মোবাইল গেমের অস্তিত্ব কেউ কখনো খুঁজে পায় নি।
যেহেতু গেম শব্দটির মানে বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানের দিকে মোবাইল বা পিসি গেম হিসেবেই বোঝায়, তাই এসব দেশে গুজবটি ছড়িয়ে পড়লে এটি রুপ নেয় ‘ডিপ ওয়েব’-এর গোপন গেম হিসেবে। অথচ রাশিয়া বা অন্য কোন দেশের মিডিয়ায় এটিকে মোবাইল/পিসি গেম হিসেবে হিসেবে সম্বোধন করা হয় নি। এমন কি কোন মিডিয়ায় ‘ডিপ ওয়েব’ শব্দটিও ব্যবহার করা হয় নি।
ব্লু হোয়েলের উৎপত্তি
২০১৬ সালে সর্বপ্রথম রাশিয়ায় (বাংলাদেশি মিডিয়াগুলো দাবী করে সারা বিশ্বব্যাপী) ১৩০ জনের মৃত্যুর পেছনে ব্লু হোয়েল গেমের হাত থাকার দাবী উঠে। ‘নোভেয়া গাজেটা’ (Novaya Gazeta) নামক একটি রাশিয়ান সাইটে দাবীটি করা হয়।[1] নোভেয়া গাজেটা তাদের রিপোর্টটি করে রাশিয়ার সোশ্যাল মিডিয়া সাইট ‘ভিকে’ কেন্দ্রিকে বিভিন্ন ‘ডেথ গ্রুপ’, যারা আত্মহত্যার প্ররোচনা দেয় তাদের উপর। সেখানে শুরুতেই বলা হয়―
“আমরা মোট ১৩০টি শিশুর আত্মহত্যার ঘটনা সনাক্ত করেছি যেগুলো রাশিয়ায় নভেম্বর ২০১৫ থেকে এপ্রিল ২০১৬ তারিখের মধ্যে ঘটেছে । এসবের কেসের প্রায় প্রতিজনই এই ধরণের গ্রুপগুলোর (ডেথ গ্রুপের) সদস্য ছিলো।”
“We have counted 130 suicides of children that occurred in Russia from November 2015 to April 2016 – almost all of them were members of the same groups on the Internet.”
তাদের এই দাবীটি পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা ভিত্তিহীন বলে সনাক্ত করা হয়।[2] ফিলিপ বুদেইকিন (Philipp Budeikin) নামক একজনকে এসব গ্রুপের পেছনে মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যাকে মে ২০১৬ তারিখে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৬ জন কিশোরীকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছে বলে সে অভিযোগ স্বীকার করে নেয়। যা তার ভাষ্যমতে, ‘সমাজ পরিষ্কারকরণ’ এর দায়িত্বপালন।[3]
এই বছর ফেব্রুয়ারিতে কিছু ইংরেজি ওয়েবসাইটে ব্লু হোয়েল নিয়ে রিপোর্ট করলে ব্লু হোয়েল নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পরে অসংখ্য দেশে। নষ্ট বা পচা ডিমকে মিডিয়ার প্রচারণার পর যেমন নকল বা প্লাস্টিকের ডিম বলা শুরু হয়, ঠিক তেমনি এসব রিপোর্টগুলোর প্রচারের পর আত্মহত্যার ঘটনাগুলোর কোনকোনটিকে সনাক্ত করা হয় ব্লু হোয়েলের মোড়কে। পূর্বে যেমন করে নকল ডিম দেখে নি এমন বিশেষজ্ঞের মতামত প্রচার করা হয় নকল ডিমের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য, ঠিক সেইভাবেই এসব রিপোর্টগুলোতেও ব্লু হোয়েল গেম খেলে নি বা দেখেনি এমন একাধিক বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের অভিমত প্রচার করা হয়েছে।
উইকিপিডিয়ায় ব্লু হোয়েল গেম
ব্লু হোয়েল গেমের এর উপর উইকিপিডিয়ার পেইজে গেলে দেখা যায় এই গেইমে আক্রান্ত কিছু দেশের তালিকা। খেয়াল করলে দেখা যাবে উল্লেখিত সব ঘটনাই এই বছরের ফেব্রুয়ারির পর, যখন ইংরেজি কিছু ওয়েবসাইট গেমটি নিয়ে হাইপ তৈরি করে খবর প্রকাশ করে, ঠিক তারপর থেকেই রিপোর্ট করা। এই ঘটনাগুলোর সর্বশেষ সংযোজনা হচ্ছে বাংলাদেশে স্বর্ণার মৃত্যুর খবরটি। যেখানে ‘সগর্বে’ জ্বলজ্বল করছে বানোয়াট খবরটি এবং ভবিষ্যতে বিশ্বাস জোগাবে এই বিষয়ে প্রচারিত নতুন গুজবের―
“বাংলাদেশি মিডিয়ায় এই গেমের সাথে সংশ্লিষ্ট আত্মহত্যার চেষ্টা করার একাধিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। অক্টোবর ২০১৭ তারিখে এক কিশোরী এই গেমে আসক্ত হয়ে আত্মহত্যা করে এমন অভিযোগ আসে।”
“Many news reports have published on Bangladeshi media about attempted suicide related with the game. A teenage girl committed suicide allegedly from the addiction of the game in October, 2017.”
স্বর্ণার মৃত্যুর সাথে ব্লু হোয়েলের সম্পর্ক পাওয়া যায় নি সেটি ইতিমধ্যে আমরা জানি। খেয়াল করলে দেখা যায় উইকিপিডিয়ার পেইজে উল্লেখিত বাকি ঘটনাগুলোও কমবেশি এরকম ভিত্তিহীন, ধারণাপ্রসূত, গুজব কিংবা বানোয়াট খবরের উপর ভিত্তি করে তৈরি। এই পেইজে উল্লেখিত সংখ্যা কিংবা দেশের তালিকা আমাদের মিডিয়াগুলোর নজরে আসলেও ঘটনাগুলোর বিবরণ খতিয়ে দেখার যথেষ্ট প্রয়োজনবোধ করে নি কেউই। অথচ এই পেইজের একাধিক জায়গায় উল্লেখ আছে এসব ঘটনাগুলোর অধিকাংশই অপ্রমানিত বা স্রেফ গুজব।
ব্লু হোয়েল নিয়ে ভ্রান্ত ধারণাগুলো
১। ব্লু হোয়েল একটি মোবাইল গেম: ব্লু হোয়েল কোন মোবাইল বা কম্পিউটার ভিত্তিক গেম না। এটি একটি মৌখিক বা লিখিত (ট্রুথ ওর ডেয়ার -এর মত) চ্যালেঞ্জভিত্তিক গেইম, যেখানে অংশগ্রহণকারীদের কিছু টাস্ক দেওয়া হয় পালন করার জন্য। এসব টাস্কগুলো মূলত আত্মঘাতী প্রকৃতির এবং অংশগ্রহণকারীরা হয় সাধারণত আত্মহনন করতে চায় এমন ব্যক্তিরা। এই গেমটি খেলার মাধ্যম হিসেবে বেঁছে নেওয়া হয় সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলো এবং সেখানে তৈরি করা হয় এই বিষয়ক গ্রুপ। ‘ডেথ গ্রুপ’ নামে পরিচিত এই গ্রুপগুলোতে বিভিন্ন লেখা কিংবা ছবির মাধ্যমে আত্মহত্যা বা নিজেদের ক্ষতি করে এমন কাজ করতে প্ররোচনা দেওয়া হয়।[5]
২। ব্লু হোয়েল গেমের পেছনে আছে শক্তিশালী হ্যাকার গোষ্ঠী: কোন কোন রিপোর্টে প্রকাশ করা হয় এই ‘মোবাইল’ গেমটি তৈরি করেছে ভয়ঙ্কর কিছু হ্যাকার, যারা ‘ডিপ ওয়েব’-এ ছেড়ে দিয়েছে এই ঘাতক গেমটি। অথচ এটি সম্পূর্ণ বানোয়াট সংবাদ। ব্লু হোয়েল গেমের আইডিয়া মিডিয়ার কল্যাণে (!) ব্যাপকভাবে প্রচারের ফলে তৈরি হয় মানুষের কৌতূহল। এই কৌতূহলকে সনাক্ত করে একদিকে যেমন তৈরি হয় ক্লিকবাজ নিউজপোর্টালগুলোর বানোয়াট সংবাদ বা সেসবের উপর নির্ভর করে তৈরি করা অসংখ্য ইউটিউব ভিডিও, অপরদিকে তা আকৃষ্ট করে কুচক্রী মোবাইল এপস ডেভেলপারদের। তারা কেউ কেউ ব্লু হোয়েলের নাম ব্যবহার করে তৈরি করে কিছু মোবাইল অ্যাপ। কিছু হ্যাকার গোষ্ঠী আবার এই নামে ছড়িয়ে দেয় ক্ষতিকারক কিছু অ্যাপ। ব্লু হোয়েল খেলেছে এমন দাবী যারা করেছে তারা মূলত এসব গোষ্ঠীর তৈরি করা ভুয়া গেমের চক্রান্তের শিকার।
৩। এই গেমে অংশগ্রহণকারীদের আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়: অনেক রিপোর্টে বলা হয় এই গেমে অপর প্রান্তে বসে থাকা ‘এডমিন’ মনোবিজ্ঞানের কৌশল কাজে লাগিয়ে সম্মোহিত করে কিংবা ব্ল্যাকমেইল করে অংশগ্রহণকারীদের আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে। এটিও কল্পনাপ্রসূত এবং কিছুটা হলিউড সাইকো মুভিগুলোর থেকে প্রভাবিত ধারণা। ব্ল্যাকমেইল করে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা অনেক দুষ্কৃতিকারীদের পুরনো কৌশল। যার শিকার হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধি পার করছে এমন কিশোর-কিশোরী, যারা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে এসব ব্ল্যাকমেইলের দ্বারা প্রভাবিত হয়। কিন্তু বিশেষভাবে ব্লু হোয়েলের কোন ঘটনায় (দাবী করা হলেও) এমন বাধ্য করে আত্মহত্যা করার প্রমাণ পুলিশী তদন্তে উঠে আসে নি।[5][6][7][8][9] বরং এসব আত্মহত্যা উৎসাহ প্রদানকারী অনলাইন গ্রুপগুলোতে সদস্যদের আত্মঘাতী আচরণের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয় এবং বিভিন্ন টাস্কের মাধ্যমে আত্মহত্যাকে ‘অর্থপূর্ণ’ ও ‘আকর্ষণীয়’ করে তোলার চেষ্টা করা হয়।
আমরা আশা করি সত্যতা জানার মাধ্যমে ব্লু হোয়েলের মত একটি ভিত্তিহীন বিষয় শীঘ্রই মানুষের আগ্রহ হারাবে এবং মিডিয়াও এমন বিষয়গুলোকে প্রচার হওয়ার সুযোগ না করে দিয়ে, সঠিক ও গবেষণাভিত্তিক তথ্য প্রচারের মাধ্যমে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবে।
সংশ্লিষ্ট পোস্টসমূহ:
- ‘ব্লু হোয়েল’ গেম খেলার মাধ্যমে বাংলাদেশি কিশোরীর মৃত্যু?
- বাজারে কি ‘নকল’ বা ‘প্লাস্টিক’ ডিম পাওয়া যাচ্ছে?
অনলাইনে চলমান বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আপনার গঠনমূলক পর্যবেক্ষন কিংবা অভিমত আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবো। আমাদের পাঠাতে হবে [email protected]এই ঠিকানায়। অথবা যাচাই-এর ফেসবুক পেইজ-এ সরাসরি পাঠিয়ে দিতে পারেন।