‘ফাবিপিরাভির’ (Favipiravir) জাপানে আবিষ্কৃত এক প্রকার এন্টিভাইরাল ঔষধ। এটি প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন না। অর্থাৎ, এটি সুস্থ মানুষের দেহে রোগ সংক্রামণ প্রতিরোধ করে না। আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা হিসেবে এই ঔষধ বিভিন্ন দেশে পরীক্ষাধীন রয়েছে।
এই ঔষধটি ‘আভিগান’ (Avigan) নামে জাপানে বাজারজাত করা হয়। দেশটি ২০১৪ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের চিকিৎসার জন্য সর্বপ্রথম শর্তসাপেক্ষে এই ঔষধের অনুমোদন দেয়। সম্ভাব্য ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করে, প্রচলিত এন্টিভাইরাল যেসব ক্ষেত্রে কাজ করে না, শুধুমাত্র সেসব ক্ষেত্রে ঔষধটি ব্যবহারের অনুমোদন প্রদান করা হয়।
ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে চীন সরকার নতুন করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষিত ঔষধটি রোগীদের উপর পরীক্ষার জন্য অনুমোদন দেয়। পরীক্ষায় সন্তুষ্টজনক ফলাফলের ভিত্তিতে মার্চ মাসে চীন নিজ দেশে এই ঔষধ উৎপাদন শুরু করে। চীনের দাবী অনুযায়ী, যেসব রোগীকে এই ঔষধ প্রয়োগ করা হয় তারা ৪ দিনে সেরে উঠেছে। অপরদিকে যাদের এটি দেওয়া হয়নি তাদের সারতে ১১ দিনের মত সময় লেগেছে। অর্থাৎ, প্রয়োগকৃত ঔষধ দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র মাইল্ড বা হাল্কা আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে, যারা আভিগানের মত কোন বিশেষ ঔষধ ছাড়াই ১০-১৪ দিনের মধ্যে সাধারণত সেরে উঠে।

কিছুদিন পূর্বে The Bangladesh Today নামক একটি নিউজ পোর্টাল “করোনা প্রতিরোধে সম্পূর্ণ কার্যকর জাপানি ওষুধ এবার বাংলাদেশে” শিরোনামে একটি বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশন করে।
তবে গুরুতর রোগী, যাদের এই ভাইরাস প্রকটভাবে আক্রান্ত করেছে, তাদের ক্ষেত্রে এই ঔষধ প্রয়োগে তেমন ফল পায়নি বলে জানায় স্বয়ং জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এই ঔষধের পক্ষে বেশ উৎসাহ প্রকাশ করে আসলেও, তার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখনো ঔষধটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা মাথায় রেখে, সতর্কতার সাথে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে।
এই সতর্কতার অন্যতম কারণ হচ্ছে পূর্বে জাপানে ৬০ দশকের দিকে পেটের সমস্যার জন্য থালিডমাইড নামক একটি ঔষধ খাওয়ার ফলে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় প্রায় ১,০০০ শিশু বিকলাঙ্গ অবস্থায় জন্মায়। যাদের মধ্যে মাত্র ৩০০ জন বাঁচে।
আভিগান কীভাবে কাজ করে?
আভিগান মূলত কোষ বিভাজনের উপর প্রভাব ফেলে ভাইরাসের বৃদ্ধি ধীর করতে সাহায্য করে। পশুর উপর পরীক্ষার সময় আভিগান বা ফাবিপিরাভির প্রয়োগেও প্রজনন সংক্রান্ত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। তাই গর্ভবতী নারী কিংবা বাচ্চা নিবে এমন পুরুষের ক্ষেত্রে এই ঔষধ গ্রহণ তাদের অনাগত বাচ্চার গঠনের উপর প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করা হয়।
আভিগান নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া
কার্যকারিতার বিপরীতে ‘যথেষ্ট’ প্রমাণ না থাকায় ও সম্ভাব্য ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য দক্ষিণ কোরিয়া ঔষধটি মার্চ মাসে আমদানি বন্ধ করে দেয়। তবে ইতালি, ইন্দোনেশিয়া, ইজরাইল ও থাইল্যান্ড এই ঔষধ করোনাভাইরাস রোগের চিকিৎসার জন্য ইতিমধ্যে আমদানি শুরু করেছে।
মার্চ মাসের শেষে আভিগান ঔষধ প্রস্ততকারক প্রতিষ্ঠান ফুজিফিল্ম, জাপানে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর উপর এই ঔষধের ৩য় ধাপ (Phase III) পরীক্ষা শুরু করে এবং এপ্রিলের ৯ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রে ২য় ধাপ (Phase II) পরীক্ষা শুরু করে। এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ধাপগুলো প্রত্যেক রোগীর জন্য ১৪ দিন ধরে চলতে পারে বলে জানা যায়।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এপ্রিলের ৭ তারিখ একটি প্রেস কনফারেন্সে দেশটির ১২০ জন রোগীর উপর আভিগান প্রয়োগে তাদের রোগের উপসর্গ নিরাময়ে ইতিবাচক ফলাফল পাচ্ছে বলে জানান।
Position Not Setআভিগান নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া
এপ্রিল ৯ তারিখে একজন বাংলাদেশী জাপান প্রবাসীর ফেসবুক প্রোফাইল থেকে জাপানের জাতীয় গণমাধ্যম NHK এর বরাত দিয়ে একটি স্ট্যাটাসে দাবী করা হয় যে এই পরীক্ষার (আনঅফিশিয়াল) ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।
তার এই স্ট্যাটাস প্রকাশের পর সেটি নিমিষেই ভাইরাল হয়ে যায় এবং মূল লেখাটির আগে-পিছে সংযোজন ও বিয়োজন করে তৈরি করা হয় নতুন নতুন স্ট্যাটাস ও ইউটিউব ভিডিও। এর মধ্যে “পৃথিবীর ৬০০ কোটি মানুষ মনে হয় একটা সুসংবাদ পেতে যাচ্ছে খুব শীঘ্রই…”– স্ট্যাটাসটি সবচেয়ে বেশী ভাইরাল হয়। অথচ, পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যা ৮০০ কোটির কাছাকাছি।
জাপানের NHK কিংবা ফুজিটিভি এমন সংবাদ পরিবেশন করেছে কিনা তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তাই মূল পোস্টকারীর দাবীকে অসত্য বলার মত যথেষ্ট প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। যেহেতু জাপান সরকার ও ফুজিফিল্ম, এই গবেষণার প্রধান ও সবচেয়ে উৎসাহী দুইটি পক্ষ, তাই তাদের নিজস্ব চ্যানেলে এমন সংবাদ প্রচার হয়ে থাকতেও পারে। তবে চলমান ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের দাবীকৃত ফলাফল আন্তর্জাতিক কোন গণমাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশে বেক্সিমকো ও বিকন ফার্মা ফাবিপিরাভির ঔষধের ফর্মুলা ব্যবহার করে বাজারে এই জাতীয় ঔষধ তৈরি করেছে বলে সংবাদে প্রকাশ করা হয়েছে। জাপানের ফুজিফিল্ম-এর ফাবিপিরাভির ঔষধের প্যাটেন্ট থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এই প্যাটেন্টের আওতা মুক্ত থাকবে।
অনলাইনে চলমান বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আপনার গঠনমূলক পর্যবেক্ষন কিংবা অভিমত আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবো। আমাদের পাঠাতে হবে [email protected]এই ঠিকানায়। অথবা যাচাই-এর ফেসবুক পেইজ-এ সরাসরি পাঠিয়ে দিতে পারেন।