অনুসন্ধান

প্রথম প্রকাশ:

প্রতিষ্ঠার প্রায় ৮ বছরে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন সবচেয়ে বেশী আলোচনায় আসে ২০২০ সালে তাদের করোনাকালীন দাতব্য খাদ্য বিতরণের উদ্দ্যোগের মধ্য দিয়ে। তবে ৫ মে, ২০২০ তারিখে “ধর্মের কারণে পদত্যাগ করেছেন ‘বিদ্যানন্দ’র প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাশ” এমন একটি সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সেটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়।

প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেইজ থেকেও ‘সাম্প্রদায়িক আচরণের কারণে কিশোর কুমার দাশ দায়িত্ব থেকে অব্যহতি নিচ্ছেন’—এমন ইঙ্গিত প্রদান করে পোস্ট করা হয়। কিন্তু সেই পোস্টটি পরে সরিয়ে নিয়ে এরূপ বিষয়টিকে অস্বীকার করে বলা হয়, তার পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশের মূল কারণ সাম্প্রদায়িক চাপ নয়, বরং প্রবাসী হওয়ার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমে সশরীরে যথেষ্ট সময় দিতে না পারা এবং প্রতিষ্ঠানটিকে প্রতিষ্ঠাতা কেন্দ্রিক না রেখে নেতৃত্বে অন্য সদস্যদের আসতে উৎসাহিত করা।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নিয়ে সাম্প্রদায়িক আচরণের সত্যতা কতটুকু?

২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন একটি শিক্ষা সহায়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সরকার নিবন্ধিত সংগঠনটি সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণীর ছেলেমেয়েদের শিক্ষা সংক্রান্ত সহায়তা প্রদান করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি ‘১ টাকায় আহার’ নামক একটি উদ্যোগের মাধ্যমে প্রায় প্রতিদিন ১,৫০০ দুঃস্থ মানুষের মাঝে মাত্র ১ টাকার বিনিময়ে খাদ্য প্রদান করা শুরু করে। মূলত এই কার্যক্রমের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠানটি সবার কাছে সমাদৃত ও সুপরিচিত হয়।

প্রতিষ্ঠানটি ধর্মীয় কোন সংগঠন নয়। এর নামটি এসেছে ‘বিদ্যা+আনন্দ’ থেকে এবং নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির নাম অনুসারে নয়। বিভিন্ন ধর্মালম্বি (প্রতিষ্ঠানটির দাবী অনুযায়ী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ) স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারাই এই সংগঠনটি পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি ইসলাম ধর্মালম্বীদের যাকাত থেকে অনুদান সংগ্রহ করে, তাই প্রতিষ্ঠানটির নাম, কার্যক্রম, উদ্দেশ্য ও প্রতিষ্ঠাতার ধর্ম প্রায়শই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়।

তবে বিভিন্ন চক্রান্তকারী মহল বিভিন্ন সময় এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে সাম্প্রদায়িক বিভেদ আনার চেষ্টা করেছে। বিশেষত ইসলাম ধর্মালম্বীদের রমাদানে দুস্থদের ইফতার খাওয়ানোর কার্যক্রমকে প্রায় সময় নানান ভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়। ২০১৭ সালে ‘যাচাই’ থেকে এমন একটি গুজবের সত্যতা প্রকাশ করা হয় যার দাবী ছিলো―

“এই বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নামের এক সংগঠন যারা কিনা চরম পর্যায়ের ইসলাম বিদ্বেষী একটি সংগঠন। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের ক্ষতি করা। তারা এই উদ্দেশ্য সফল করতে তাদের এই রকম উদ্যোগ গ্রহন। তারা ইফতারের খাবারের সাথে তাদের ”মা গরুর মুত্র” মিশিয়ে ইফতার তৈরী করে মুসলমানদের মধ্যে তা বিতরন করার উদ্যোগ নেই। যাতে করে মুসলমানদের সারা দিনের কষ্টের রোজা এই নাপাক ইফতারি খেয়ে নষ্ট হয়ে যায়।”

বিবিসি’র নাম দিয়ে করা ভুয়া একটি সাইটে প্রকাশিত বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নিয়ে বানোয়াট খবরটি সেই সময় বেশ ভাইরাল হয়। ২০২০ সালে করোনা প্রাদূর্ভাব শুরু হলে, প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমে আঘাত আনা হয়। একাধিকবার তাদের ‘১ টাকায় আহার’ নামক পেইজটি সুসংবদ্ধভাবে রিপোর্ট করে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

‘Srabon Ispahani-শ্রাবন ইস্পাহানী’ নামক একটি ফেসবুক পেইজ থেকে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নিয়ে প্রচার করা হয় এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব

সম্প্রতি ‘Srabon Ispahani-শ্রাবন ইস্পাহানী’ নামক একটি ফেসবুক পেইজ থেকে ‘উপরে বিদ্যানন্দ, ভিতরে ইস্কনানন্দ- ১ম পর্ব‘ শিরোনামে একটি পোস্ট মে ৫ তারিখের বিতর্ক শুরু হওয়ার একদিন আগে, মে ৪, ২০২০ তারিখে প্রকাশ করা হয়। পোস্টটিতে প্রতিষ্ঠানটিকে ভারতীয় কট্টরপন্থী ধর্মীয় সংস্থা ইস্কন (ISKCON) এর একটি উপ-প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাবী করা হয়। পোস্টটি আমাদের এই লেখা প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত মাত্র ১ দিনেই ২ হাজার ৩০০ বারের উপর শেয়ার হয়। মে ৬ তারিখ রাত ১টায় প্রকাশিত হয় এর ২য় পর্ব। যা প্রকাশের মাত্র ১ ঘন্টার মাঝেই প্রায় শতাধিক শেয়ার লাভ করে।

বাংলাদেশে অনলাইনে সাম্প্রদায়িক উস্কানি প্রদান করে কারা?

‘যাচাই’ এর অনুসন্ধানে দেখা যায় এই পেইজটি এই মার্চে ‘Srabon bosu-শ্রাবন বসু’ নামে  তৈরি করা হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি তা ‘শ্রাবন ইস্পাহানী’ নামে পুনঃনামকরণ করা হয়। এই পেইজের পোস্টগুলো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব (Conspiracy Theory) প্রকৃতির এবং অনেক পোস্টে তথ্যবহুল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপতথ্য দ্বারা সাম্প্রদায়িক উস্কানি প্রদান করা হয়। এই পেইজটি অন্তত তিনটি দেশ থেকে পরিচালনা করা হয়, যার একটিও বাংলাদেশ নয়।

‘Srabon bosu-শ্রাবন বসু’ পেইজটি অন্তত তিনটি দেশ থেকে ৪ জন পরিচালনা করে। এদের কেউই বাংলাদেশ থেকে নয়।

এমন আরেকটি সুপরিচিত তথ্যবহুল ষড়যন্ত্র তত্ত্ব (Conspiracy Theory) প্রকৃতির ফেসবুক পেইজ হচ্ছে ‘Noyon Chatterjee 6’। ২০১৬ সালে তৈরিকৃত পেইজটির ফলোয়ার ৭০ হাজারেরও বেশী। এই পেইজটি তথ্যবহুল গবেষণাধর্মী অপতথ্য দ্বারা সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক উস্কানি প্রদান করে। এই পেইজটিও পরিচালিত হচ্ছে ৮ জন ব্যক্তি দ্বারা এবং বাংলাদেশ সহ আরও তিনটি দেশ থেকে।

‘Noyon Chatterjee 6’ পেইজটি অন্তত ৪টি দেশ থেকে ৮ জন মানুষ দ্বারা পরিচালিত।

সনাতন ধর্মী নাম ব্যবহার করে প্রচারিত এই পেইজগুলো কার্যক্রম ও ভাষাগত দিক থেকে হুবহু একই প্রকৃতির। এসব পেইজের নাম হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নাম সদৃশ হলেও এসব পেইজের পোস্টে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের উস্কানি দিয়ে অপর ধর্ম বিদ্বেষী পোস্ট প্রচার করা হয়। এছাড়াও নানান ধরণের সরকার বিরোধী তত্ত্ব এখানে এমনভাবে তুলে আনা হয় যেন তা অনেক গবেষণাধর্মী ও তথ্যবহুল।

বিভিন্ন তথ্যসূত্র দেখিয়ে তাদের বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য করে প্রকাশের চেষ্টা করা হয়।

অথচ খেয়াল করে কেউ যাচাই করে পড়লে দেখতে পাবে যে এসব পেইজের দাবীগুলোর অধিকাংশই কুযুক্তি, অপব্যাখ্যা ও ভিত্তিহীন উৎস থেকে সৃষ্ট। সুচিন্তিতভাবে লেখা এসব অপতথ্যের শিকার হয় সাধারণ মানুষ এবং তা ছড়িয়ে দেয় অসংখ্য চেনা-অচেনা অনলাইন মাধ্যমে।

‘Noyon Chatterjee 6’ নামে পরিচালিত ফেসবুক গ্রুপে নিয়মিত শেয়ার করা হয় বিদ্বেশমূলক পোস্ট। চরমপন্থীদের টার্গেট হয় এই ধরণের গ্রুপগুলো।

তথ্যবহুল গবেষণাধর্মী অপতথ্য কী?

এটি অপতথ্য প্রচারের এমন একটি উপায় যার মাধ্যমে পাঠককে গবেষণাধর্মী লেখার মত করে অজস্র তথ্য গ্রাস করানো হয়। যেসব ব্যাপারে অধিকাংশেরই প্রাথমিক জ্ঞান থাকে না। অনেক তথ্যসূত্র উল্লেখ করে পাঠকের কাছে লেখাটি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। এসব তথ্যগুলো সুনির্দিষ্টভাবে কিছু প্রমাণ না করলেও লেখার মধ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু শব্দ বারবার পুনরাবৃত্তি করে পাঠকের মনে কিছু বিশ্বাস ও ধারণা ক্রমে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।

লেখাগুলো প্রথমে শুরু হয় সাধারণ মানুষের সাধারণ বিশ্বাসগুলোকে ইতিবাচক স্বীকৃতি প্রদান করার মাধ্যমে। তাদের আবেগ ও আক্ষেপের জায়গাগুলো ব্যবহার করে তাদের বিশ্বাস অর্জন করার চেষ্টা চালানো হয়। একসময় এমন তথ্যের বারবার পুনরাবৃত্তিতে একটি গোষ্ঠীর আচরণ ও চিন্তায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার শুরু করে এবং সেটি তাদের চরমপন্থি কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করে।

সারা বিশ্বেই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ব্যবহার করে মানুষের বিশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণের এমন প্রচেষ্টা রয়েছে। টার্গেট গ্রুপের ভিন্নতায় এদের ধর্মীয় বিশ্বাস কেন্দ্রিক বক্তব্য ভিন্ন (কিছু ক্ষেত্রে পরস্পরের বিপরীত) হলেও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদিতে এদের আলোচনার ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো সাধারণত একমুখী হয়।


অনলাইনে চলমান বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আপনার গঠনমূলক পর্যবেক্ষন কিংবা অভিমত আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবো। আমাদের পাঠাতে হবে [email protected]এই ঠিকানায়। অথবা যাচাই-এর ফেসবুক পেইজ-এ সরাসরি পাঠিয়ে দিতে পারেন।

পাদটীকা

মন্তব্য