বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথির মতো অপবিজ্ঞান ভিত্তিক (Pseudoscientific) চিকিৎসার[1] সাথে মানুষ পরিচিত থাকলেও, বিকল্প ঔষধের (Alternative medicine) অন্যতম অপবিজ্ঞান ভিত্তিক চিকিৎসা ন্যাচারোপ্যাথির সাথে মানুষের পরিচিতি খুব কম। যারা এই ব্যাপারে কিছুটা জানে তারা কেবল যোগশাস্ত্র, অর্থাৎ, ভারত ভিত্তিক ন্যাচারোপ্যাথির সংস্করণকে চিনে।
ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির ২০০০ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। তবে তিনি ডায়েট পরামর্শ সহ যেসকল চিকিৎসা পদ্ধতি সাধারণত প্রচার করে থাকেন এবং যেসকল উপাদান খাওয়ার পরামর্শ দেন, তার অধিকাংশই এই এমবিবিএস ডিগ্রির অন্তর্ভুক্ত নয়। তার চিকিৎসা পরামর্শ, প্রেসক্রাইব করা ঔষধ ও বিভিন্ন ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট মূলত ন্যাচারোপ্যাথির অংশ।
অর্থাৎ, মূলধারার ঔষধ, এলোপ্যাথি — প্রমাণ ও গবেষণা ভিত্তিক মেডিসিনে পড়াশুনার জন্য ডাক্তার উপাধি পেলেও, ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির মূলত অবৈজ্ঞানিক ও ধারণাভিত্তিক ন্যাচারোপ্যাথি পদ্ধতির চিকিৎসা প্রচার করে আসছেন।
ন্যাচারোপ্যাথি কী?
বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত হোমিওপ্যাথির মূল নীতি হচ্ছে ‘বিষে বিষ ক্ষয়’। এই পদ্ধতিতে বিশ্বাস করা হয়, স্বল্প পরিমাণে কোনো রোগের উদ্দীপক পদার্থ শরীরে প্রবেশ করানো হলে আমাদের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা নির্দিষ্ট ঐ রোগকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়ে উঠে।
কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন ঔষধ তৈরিতে রোগের উদ্দীপক পদার্থ এতটাই পাতলা করে ফেলা হয় যে সেই উদ্দীপকের উপস্থিতিই ঔষধে আর থাকে না। বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনায় দেখা গিয়েছে যে, হোমিওপ্যাথিক ওষুধ প্রয়োগের ফলে কোনপ্রকার শারীরিক পরিবর্তন হয় না।[2][3][4]
অধিকাংশ ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি থেকে প্রাপ্ত সুফল পানি পোড়ার মতো শুধুমাত্র ‘প্ল্যাসিবো এফেক্ট‘ ধরা হয়।
যখন কোনো রোগীকে এমন কোনো চিকিৎসা কিংবা ঔষধ দেওয়া হয়, যেটির নিজস্ব কোনো ঔষধি গুণাবলী থাকে না কিন্তু সেটি গ্রহণের ফলে রোগীর মনে হয় তার রোগ সেই চিকিৎসার জন্যই সেরে যাচ্ছে, তখন সেটিকে প্ল্যাসিবো এফেক্ট বলে।
অপরদিকে, ন্যাচারোপ্যাথি (Naturopathy) ঔষধের ধারণা তৈরি হয়েছে বিভিন্ন তথাকথিত প্রাকৃতিক ঔষধি উপাদানের উপর, যা ‘নিউট্রাসিটিক্যাল’ (Nutraceutical) নামে পরিচিত। এসকল উপাদানের কার্যকারিতা মিনারেল ও ভিটামিনের গুণাবলীর উপর ভিত্তি করে প্রচার করা হয়। অর্থাৎ, এখানে চিন্তাপদ্ধতি হচ্ছে, ভিটামিন সি ও ডি যেহেতু রোগ প্রতিরোধ করতে আমাদের সহায়তা করে, তাহলে এসব উপাদান সমৃদ্ধ উপাদান খেলে আমাদের শরীর যেকোনো জীবাণুকেও প্রতিরোধ করতে পারবে।

এখানে বিভিন্ন জীবাণু শরীরে কীভাবে কাজ করে, আমাদের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বিভিন্ন উপাদানের সাথে কীভাবে ক্রিয়া করে কিংবা বিভিন্ন ভিটামিন মানব শরীরে কীভাবে সংরক্ষিত হয় ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রাখা হয় না।
কোনোকোনো সময় হোমিওপ্যাথিকেও ন্যাচারোপ্যাথির অংশ হিসেবে ধরা হয়।
ন্যাচারোপ্যাথির ক্ষতিকর দিক কী?
যদিও ন্যাচারোপ্যাথি মূল ধারার চিকিৎসা থেকে জীবনধারা বা লাইফস্টাইল সম্পর্কিত সঠিক অনেক পরামর্শ গ্রহণ করে যেমন, পর্যাপ্ত ঘুম, ভারসাম্য খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম ইত্যাদি, কিন্তু এই চিকিৎসা মূলত কিছু অবৈজ্ঞানিক ও অপ্রমাণিত বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে চর্চা করা হয়। যা অনেক সময়, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক।
যেকোনো চিকিৎসাই মূলধারার চর্চায় আসার পূর্বে একাধিক টেস্ট ট্রায়াল, উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী উপর প্রয়োগ ও বিশেষজ্ঞদের দ্বারা ফলাফল রিভিউ হয়ে আসে। কিন্তু ন্যাচারোপ্যাথি তথা বিকল্পধারার চিকিৎসায় এসব প্রক্রিয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানা হয়; বরং বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত বিষয়গুলোর ভুল ব্যাখ্যা প্রদান ও ব্যক্তিগত ধারণা উপর ভিত্তি করে রোগ সমাধানের চেষ্টা করে। এই কারণেই এসব চর্চাকে অপবিজ্ঞান ভিত্তিক (Pseudoscientific) চিকিৎসা বলে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি
ন্যাচারোপ্যাথির প্রধান ক্ষতিকর দিক হচ্ছে এর চর্চাকারীরা ‘প্রাকৃতিক চিকিৎসা’র শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে মানব শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করে। অর্থাৎ, প্রকৃত ক্ষমতার থেকে বেশী কিছু হিসেবে এটিকে বুঝিয়ে থাকে। আর এটি করতে গিয়ে তারা কিছু ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কার্যপদ্ধতি, যেমন, ইননেট ইমিউন সিস্টেম সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা প্রদান করে।
অপরীক্ষিত ও অপ্রমাণিত চিকিৎসা পরামর্শ
ন্যাচারোপ্যাথি চর্চাকারীরা সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে ক্যান্সার কিংবা কোভিড-১৯ এর মতো রোগের ব্যাপারে অপতথ্য প্রচার করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরা নিজস্বার্থে অপবিজ্ঞান ও অপচিকিৎসাও প্রচার করে থাকে।
ভারতের বিখ্যাত ন্যাচারোপ্যাথি চর্চাকারী স্বামী রামদেভ শুধুমাত্র নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থে ‘করোনিল’ নামক এক অপরীক্ষিত কোভিড-১৯ প্রতিষেধক বাজারে ছাড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পাওয়ার একটি ভুয়া দাবীও তারা প্রচার করে — যা পরবর্তীতে অসত্য প্রমাণিত হয়।
ডাঃ জাহাঙ্গীর কবিরের করোনাভাইরাস, টিকা ও এন্টিবডি সম্পর্কিত এরকম অপতথ্যমূলক ভিডিও প্রচার করে সম্প্রতি সমালোচনায় আসেন।
বাংলাদেশের অপর ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসক ডাঃ মুজিবুর রহমান অ্যাডাপ্টোজেন (Adaptogen) ও ‘মেডিসিনাল’ কোকোনাট অয়েল করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে দাবী করেন। এসব পণ্য তার কোম্পানি বাজারজাত করে থাকে। আরেকটি ভিডিওতে তিনি তার কোম্পানির ৫০,০০০ আইইউ মাত্রার ভিটামিন ডি প্রতিদিন খাওয়ার পরামর্শ দেয়; এই মাত্রায় ভিটামিন ডি গ্রহণ ‘ভিটামিন ডি টক্সিসিটি‘ সৃষ্টি করতে সক্ষম।
বিভিন্ন ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট ছাড়াও ন্যাচারোপ্যাথি হাইড্রোকোলোন থেরাপি, কোল্ড থেরাপি ও ওজন থেরাপি ইত্যাদির মতো অবৈজ্ঞানিক, অপ্রমাণিত ও কোনোকোনো ক্ষেত্রে ক্ষতিকর চিকিৎসাকেও প্রচার করে থাকে। ডাঃ মুজিবুর রহমান একটি ভিডিওতে করোনার চিকিৎসায় ওজন থেরাপির পরামর্শ দেন।
চিকিৎসকদের প্রতি অনাস্থা তৈরি
আরেকটি মারাত্মক ক্ষতি ন্যাচারোপ্যাথি চর্চাকারীরা করে থাকেন, সেটি হলো ‘ডাক্তার কসাই’, ‘ডাক্তার লোভী’ — এই কুধারণাগুলোকে সাধারণ মানুষের মাঝে আরও দৃঢ় করা।
অনেক ক্ষেত্রে অনেকের বিশেষ শারীরিক অবস্থার কারণে, অন্য জটিল শারীরিক কার্যক্রম পরিচালনা তো নয়ই, উপরন্তু তাদের শরীর মিনারেল কিংবা ভিটামিন ঠিক মতো প্রক্রিয়াজাতই করতে পারে না। সেক্ষেত্রে তাদের নির্ভর করতে হয় ঔষধের উপর। বিশেষত ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এটি খুবই সংবেদনশীল একটি বিষয়।
অথচ ডাক্তার জাহাঙ্গীর কবিরের ঢালাও শিরোনামে ‘বিনা ঔষধে রোগমুক্তির’ ভিডিওগুলো এবং ডাক্তার ও ঔষধের প্রতি নেতিবাচক ধারণার প্রসার এইধরনের রোগীদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
অপ্রমাণিত তথাকথিত প্রাকৃতিক উপাদান বিক্রয়
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপনের পিছনে ন্যাচারোপ্যাথি চর্চাকারীদের যুক্তি খুবই সহজ—
“রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একটি প্রাকৃতিক সমাধান এবং ঔষধ ও ভ্যাকসিন অপ্রাকৃতিক বিধায় এটি প্রাকৃতিক ক্ষমতাকে নষ্ট করে। তবে এটিকে তথাকথিত প্রাকৃতিক উপাদানের মাধ্যমেই বর্ধিত করে আমরা যেকোনো রোগ প্রতিরোধ করতে পারি”
আর এখানেই ন্যাচারোপ্যাথির মূল বাণিজ্য।
ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির ওজন কমানোর চিকিৎসায় অ্যাপল সিডার ভিনেগার কিংবা পাকস্থলী সংক্রান্ত সমস্যায় হিমালয়ান পিংক লবণের মতো কিছু উপাদানের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অথচ ওজন কমানোর চিকিৎসায় অ্যাপল সিডার ভিনেগারের উপকারিতা দাবীর পিছনে যথেষ্ট গবেষণা নেই।[5][6][7] অপরদিকে, সাধারণ লবণের চেয়ে প্রায় ২০ গুন দামী হলেও,[8] হিমালয়ান পিংক লবণের বিশেষ উপকারিতার দাবীগুলোর বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই।[9][10]
ঔষধের বিকল্প বাণিজ্য
“ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি থেকে টাকা পায় বলে ডাক্তাররা ঔষধ দেয়” — এমন একটি বিশ্বাসকে পুঁজি করে ন্যাচারোপ্যাথি। অথচ, এই চিকিৎসায় তথাকথিত প্রাকৃতিক বা নিউট্রাসিটিক্যাল উপাদান ক্রয় করতে উৎসাহ প্রদান করা হয়, যেসব বাজারের একই ধরণের সাধারণ পণ্যের থেকে তুলনামূলক দামী হয় এবং অধিকাংশেরই বিশেষ উপকারিতা অপ্রমাণিত।
২০১৩ সালে ভারতের স্বামী রামদেভ তার সম্পদের মূল্য ১,১০০ কোটি রুপি বলে ঘোষণা দেন। তার এরকম প্রাকৃতিক উপাদান বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ‘পতঞ্জলি’ শুধুমাত্র গত বছর, ২০২০ সালে, ৯ হাজার কোটি রুপি আয় করে, যা ১.২ বিলিয়ন ইউএসডি সমমান। যেখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে লাভজনক ঔষধ কোম্পানি স্কয়ার ফার্মার একই বছরের আয় ছিলো ৫২৬ মিলিয়ন ইউএসডি, যা পতঞ্জলির আয়ের অর্ধেক।
ডাঃ মুজিবুরের কোম্পানির নাম ‘ভেন্টেজ ন্যাচারাল’। এটি মূলত থাইল্যান্ড, রাশিয়া ও বাংলাদেশের বাজারকে টার্গেট করে নিউট্রাসিটিক্যাল পণ্য বিক্রি করে। বাংলাদেশে এই কোম্পানিটির অন্তত ১৫টি শাখা রয়েছে।
তবে ডাঃ জাহাঙ্গীর কবিরের এখনো পর্যন্ত এমন প্রোডাক্ট লাইন না আসলেও তিনি এই ধরণের পণ্য তার ‘আল্টিমেট অর্গানিক লাইফ’ নামক একটি দোকান ও তার চেম্বার হেলথ রেভ্যুলেশনে বিক্রয় করে থাকেন।
‘চক্রান্তকারী’ ঔষধ কোম্পানিরই হারবাল ঔষধ বিক্রয়
এছাড়াও ঔষধ কোম্পানিগুলো ‘ক্ষতিকর’ এমন একটি ধারণা প্রচার করলেও ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির একাধিক ভিডিওতে ও বিভিন্ন পোস্টের কমেন্টে ‘ডাক্তারি পরামর্শ’ হিসেবে ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল সহ আরও ক’টি ঔষধ কোম্পানির হারবাল লাইনের ঔষধ প্রেসক্রাইব করে থাকেন। যা তার চেম্বার ও বিক্রয়কেন্দ্রে পাওয়া যায়।

সাধারণভাবেই ‘প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি বলে এসবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না’ — এমন প্রচলিত ধারণার কারণে মানুষ এসব ঔষধ কিংবা ঔষধি উপাদান বিনা প্রশ্নে ক্রয় করে থাকে। অথচ বাস্তবে তারা মূলত সেই ঔষধ কোম্পানিগুলোর পণ্যই ক্রয় করে যাচ্ছে, যাদের থেকে রক্ষা পেতেই তাদের এই বিকল্প চিকিৎসার শরণাপন্ন হওয়া।
একই পথ্য সর্বরোগের ঔষধ
ডাঃ মুজিবুর রহমান অটিজম, যৌন দূর্বলতা, ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত ওজন, হৃদরোগ, পাইলস, ফিস্টুলা ও অ্যানাল ফিসার এমনকি কোভিড-১৯ এ প্রায় একই প্রকার পথ্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন— কোকোনাট অয়েল, ভিটামিন ডি ও অ্যাডাপ্টোজেন। ভেন্টেজ ন্যাচারাল এসকল পণ্য নিজেস্ব ব্র্যান্ডে বাজারজাত করে থাকে। অপরদিকে ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির অধিকাংশ পথ্যে হিমালয়া পিংক সল্ট পরামর্শ দিয়ে থাকেন, যেখানে এটি সাধারণ লবণের মতোই ৯৫-৯৭% সোডিয়াম ক্লোরাইড থাকে এবং ৪-৩% বিভিন্ন বিভিন্ন খনিজ পাওয়া যায়। যে সামান্য পরিমাণ লবন আমরা দিনে গ্রহণ করি রান্নার মাধ্যমে সেই হিসেবে এই অতিরিক্ত খনিজের উপকারিতা নগণ্য।
মানুষের দুর্বলতাকে ব্যবহার করে আস্থা অর্জন
ন্যাচারোপ্যাথির একটি কৌশল হচ্ছে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে এই চিকিৎসার সংযোগ করিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করা। যেমন, ডাঃ জাহাঙ্গীর মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে নামাজ ও রোজাকে প্রমোট করেন ‘লাইফ স্টাইল মোডিফাইয়ার’ হিসেবে। অপরদিকে, স্বামী রামদেভ হিন্দু প্রধান ভারতে ‘যোগশাস্ত্র’কে প্রচার করে থাকেন ‘আধ্যাত্মিক গুরু’ হিসেবে।
কিন্তু আমেরিকার ন্যাচারোপ্যাথির পিতা বেনেডিক লাস্ট নামাজ কিংবা যোগশাস্ত্র কোনটিকেই প্রমোট করেননি।

কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসের দুর্বলতাকে নয়, মানুষের ব্যক্তিগত দৈহিক দুর্বলতাকেও লক্ষ্য করে ‘প্রাকৃতিক’ সমাধান বাজারজাত করে থাকে ন্যাচারোপ্যাথি। ডাঃ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বেশী ভিউ পাওয়া ভিডিও ক’টির শিরোনাম হচ্ছে—
- ১। সেক্স হরমোন টেস্টোস্টেরন বাড়ানোর রেসিপি (নিউট্রাসিটিক্যাল উপাদানের মাধ্যমে)
- ২। সেক্স লাইফ বাড়াতে ৩ টি সহজ উপায়ে ব্যায়াম
- ৩। সেক্স হরমোন টেস্টোস্টেরন বাড়ানোর ব্যায়াম
- ৪। দ্রুত বীর্যপাত রোধে করনীয় কি
- ৫। নারী-পুরুষ উভয়ে কিভাবে হারানো যৌবন ফিরে পাবেন (ডাঃ জাহাঙ্গীর কবিরের সাথে)
ভারতের পাতঞ্জলি ‘পুত্রজীভক’ (Putrajeevak) নামে একটি পণ্য বাজারে আনে। এটি সেবন করলে পুত্র সন্তানের জন্ম হবে বলে দাবী করা হয়। এছাড়াও বাংলাদেশের রাস্তা-ঘাটে বহুল প্রচলিত ‘কলিকাতা হারবাল’-এর বিজ্ঞাপনগুলো মানুষের দুর্বলতাকে ব্যবহার করে ন্যাচারোপ্যাথি বাণিজ্য করার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
ন্যাচারোপ্যাথি কি ডাক্তারি চর্চার অন্তর্ভুক্ত?
হোমিওপ্যাথির চর্চাকারীদের মতো ন্যাচারোপ্যাথির চর্চাকারীরাও নিজেদের নামের আগে ‘ডাক্তার’ উপাধি ব্যবহার করতে পারে না, যেহেতু এসব আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান দ্বারা গ্রহণযোগ্য না। সম্প্রতি বাংলাদেশের হাইকোর্ট হোমিওপ্যাথি-ইউনানি-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকদের নামের আগে ডা. ব্যবহার করা যাবে না — এই মর্মে একটি রায়ও প্রদান করেছেন।
কিন্তু ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসা প্রচার করলেও, ডাঃ জাহাঙ্গীর কবিরের এমবিবিএস ডিগ্রি মানুষের কাছে তার চর্চাকে ‘ডাক্তারি চর্চা’ হিসেবে গ্রহণ করিয়েছে। অনেকের ধারণা তিনি যেহেতু ডায়েট নিয়ে কথা বলেন তার পুষ্টিবিজ্ঞান সম্বন্ধে পড়াশোনা আছে। অথচ ডায়াবেটিস ও শ্বাসজনিত রোগের উপর তার ৪টি কোর্স থাকলেও এর কোনটিই পুষ্টিবিজ্ঞান সম্পর্কিত নয় এবং তার কোনো বিশেষায়িত মেডিকেল ডিগ্রিও নেই।

অপরদিকে ডাঃ মুজিবুর রহমান, রাশিয়া থেকে মেডিকেল ডিগ্রি অর্জনের দাবী করলেও, তিনি একটি অসমাপ্ত পিএইচডি আলোকে নিজেকে ‘কার্ডিওলজিস্ট’ বলে উল্লেখ করেন। ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির তার বক্তব্যে ন্যাচারোপ্যাথি শব্দটি এড়িয়ে গেলেও, ডাঃ মুজিবুর রহমান একজন স্বঘোষিত ন্যাচারোপ্যাথি চিকিৎসক। তিনিও ডাঃ জাহাঙ্গীরের মতো তার মেডিকেল সাইন্সের চিকিৎসা পরিত্যাগ করে ন্যাচারোপ্যাথির বিকল্প চিকিৎসা প্রদান করছেন।
ন্যাচারোপ্যাথির সাথে চিকিৎসা বিষয়ক অপতথ্য প্রচারের সম্পর্ক কী?
অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে, ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির মেডিকেলের একজন ছাত্র হয়েও ভ্যাকসিনের মতো জিনিস নিয়ে কাল্পনিক কথা কীভাবে বলেন?
বিশ্বব্যাপী সকল প্রসিদ্ধ ন্যাচারোপ্যাথি চর্চাকারীই ভ্যাকসিন বিরোধী ধারণাকে প্রচার করে। এটি অনেকটা এই গোষ্ঠীর টেক্সটবুক কার্যক্রম।
আমেরিকার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ন্যাচারোপ্যাথির প্রচারক জোসেফ মার্কোলা (Joseph Mercola) প্রায় ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ভ্যাকসিন বিরোধী সংগঠন ‘ন্যাশনাল ভ্যাকসিন ইনফরমেশন সেন্টার’ -এ অনুদান করেন। এছাড়াও অসংখ্য স্বাস্থ্য বিষয়ক অপতথ্য প্রচারের সাথে তিনি জড়িত। যেমন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন খাবারের রাসায়নিক গঠন পরিবর্তন করে, মোবাইলের রেডিয়েশন থেকে ক্যান্সার হয়, হোমিওপ্যাথি দ্বারা অটিজম সারা যায়, এইচআইভি ভাইরাস বলে কিছু নেই।

ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির ও ডাঃ মুজিবুরের মাইক্রোওয়েভ ওভেন নিয়ে ভিডিও বিশ্বব্যাপী চলমান এই অপতথ্য ক্যাম্পেইনের অংশমাত্র। তাদের নিজস্ব গবেষণালব্ধ কিছু নয়। তাদের এসংক্রান্ত ভিডিওগুলোর অধিকাংশ তথ্য জোসেফ মার্কোলার ওয়েবসাইট সহ বিভিন্ন ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব প্রচারকারী ওয়েবসাইটে হুবহু পাওয়া যায়।

ডাঃ মুজিবুর রহমান একাধিক ভিডিওতে ভ্যাকসিন ব্যবহারের বিরোধিতা করে এসেছেন। এছাড়াও সমালোচনার মুখে ডাঃ জাহাঙ্গীর কবিরের ভ্যাকসিন সংক্রান্ত অপতথ্যমূলক ভিডিও সরিয়ে ফেললে ডাঃ মুজিবুর একাধিক ভিডিওতে ডাঃ জাহাঙ্গীর কবিরের টিকা সম্পর্কিত তথ্য সঠিক বলে উল্লেখ করেন।

ঔষধ, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ডাক্তারের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টির মাধ্যমেই ন্যাচারোপ্যাথির মতো অপ্রমাণিত চিকিৎসা পদ্ধতি টিকে থাকে। যেখানে এই চিকিৎসার বৈজ্ঞানিক ভীতই প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে একমাত্র অপতথ্যের মাধ্যমে বিজ্ঞানকে বদলিয়েই এই চিকিৎসা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব।
বিকল্প চিকিৎসার প্রতি মানুষ কেন ঝুঁকছে?
চিকিৎসা সেবায় রোগীর সাথে চিকিৎসকের যোগাযোগ স্থাপন, রোগীর প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ ও রোগীর কাছে বোধগম্য ভাষায় তার সমস্যা বুঝানোর দক্ষতা সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। যা সাধারণত ডাক্তারি পড়াশোনায় কম গুরুত্বের সাথে নেওয়া হয়। [12]
অনেকক্ষেত্রে রোগীর বোঝার ক্ষমতা ও অনুভূতি প্রকাশের প্রতি চিকিৎসকের অবজ্ঞা রোগীকে তার সমস্যা প্রকাশে অনুৎসাহিত করে এবং চিকিৎসকের চিকিৎসার প্রতি অনাস্থা তৈরি করায়।[13][14] যদিও এটি প্রমাণিত যে রোগীর সাথে যোগাযোগ সৃষ্টি করতে পারা চিকিৎসার ফলাফলেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।[15][16]
ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির সহ বিকল্প ধারার অন্যান্য চিকিৎসকদের মূল সফলতা রোগীর সাথে সহমর্মিতা প্রকাশের মাধ্যমে যোগাযোগ সৃষ্টি করতে পারার অসাধারণ ক্ষমতা। ডাঃ জাহাঙ্গীর কবিরের ভিডিওতে লক্ষ্য করা যায়, তিনি ধৈর্য সহকারে তার রোগীদের সমস্যা ও কথা বুঝার চেষ্টা করছেন। এছাড়াও সময় সময়ে আলোচনার মাধ্যমে খুবই জটিল কিছু মেডিকেল বিষয়াদি তার দর্শকদের বুঝানোর চেষ্টা করছেন, অনেক সময়ে সরাসরি আঞ্চলিক টানেই।
এসব আলোচনা কতটুকু ফলপ্রসূ এবং তার ব্যাখ্যা পদ্ধতি একজন সাধারণ মানুষের কাছে আসলেই কতটুকু বোধগম্য সেটি নিয়ে সংশয় থাকলেও, তার এই পন্থা দর্শকের জ্ঞানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। পারস্পরিক সম্মান স্থাপনের মাধ্যমে ও সাধারণ মানুষেরই একজন প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরে, ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির দর্শকদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। যেখানে মূল ধারার চিকিৎসকদের মধ্যে এই চর্চা সাধারণত লক্ষ্য করা যায় না।
রোগীর আস্থা অর্জনের এই প্রচেষ্টার প্রতি উদাসীনতা, মূল ধারার চিকিৎসকদের দূরে ঠেলে দিচ্ছে এবং সাধারণ মানুষে ঝুঁকছে বিকল্প ধারার চিকিৎসার প্রতি।
কিটো ডায়েট নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক থাকলেও, ডায়াবেটিস ও ওজন নিয়ন্ত্রণে ডাঃ জাহাঙ্গীর কবিরের লাইফস্টাইল সম্পর্কিত অধিকাংশ পরামর্শ যেমন, পর্যাপ্ত ঘুম, ভারসাম্য খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম ইত্যাদি সকল মূল ধারার ডাক্তারই দিয়ে থাকেন। যা খুব ব্যতিক্রমী কিছু না।
তবে একাধিক গবেষণায় দেখা যায় যে ওজন[17][18][19] ও ডায়াবেটিস[20][21] নিয়ন্ত্রণে রোগীকে কাউন্সেলিং — খোলামেলা আলোচনা, নিয়মিত পরামর্শ ও প্রেরণা প্রদান রোগীর অবস্থা উন্নতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। যেটি ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির তার ভিডিওতে নিয়মিত করে থাকেন।
কিটো ডায়েট বিতর্ক
২০১৬ সালের তথ্যমতে বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ২৫% মানুষ অতিরিক্ত ওজন (Overweight) ও স্থূলতা (Obesity) সম্পন্ন।[22] ২০১৩ সালের এক সমীক্ষায় বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের ক্ষেত্রে এই হার যথাক্রমে ১৭% ও ৪.৫%। বাংলাদেশে এই হার, বিশেষত, নারীদের ক্ষেত্রে, ক্রমবর্ধমান।[23]
সারা বিশ্বে কম ওজনের থেকেও বেশী মানুষ মারা যায় অতিরিক্ত ওজনের ফলে। ২০১৭ সালে পৃথিবীর মোট মৃত্যুর প্রায় ৩২% এর কারণ হৃদরোগ।[24] অতিরিক্ত ওজন থেকে যে মৃত্যুগুলো হয় তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ হৃদরোগ থেকে হয়। এছাড়াও, ডায়াবেটিসে মারা যায় ৪.৫৫%, হাড়ের জয়েন্ট জনিত সমস্যায় মারা যায় ০.২২% ও কিছু টিউমার বা ক্যান্সার সম্পর্কিত রোগ থেকে মারা যায় ১৬.৪৩% মানুষ। এসকল সব রোগেরই অন্যতম প্রধান কারণ অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা। এছাড়াও নিদ্রাকালীন শ্বাসব্যাঘাত ও গর্ভধারণের সমস্যা অতিরিক্ত ওজন ক্ষতিকারক ভূমিকা রাখে।[11]
স্থূলতার মতো সুদূর বিস্তৃত সর্বজনীন স্বাস্থ্য ঝুঁকির প্রধান চিকিৎসা নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস (ডায়েট) ও শারীরিক ব্যায়াম।
কিটোজেনিক ডায়েট (Ketogenic Diet) একটি মূলধারার পথ্য চিকিৎসা পদ্ধতি। মূলত শিশুদের মৃগীরোগের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হলেও দ্রুত ওজন কমাতে উল্লেখযোগ্য ফলাফল দেয় এই ডায়েট। ফলে এই ডায়েটের দীর্ঘ মেয়াদে কিছু জটিলতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এটি মারাত্মক কিছু রোগের ঝুঁকি কমিয়ে আনে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কেটো ডায়েট মূলত কেটোসিস নামক একটি প্রাকৃতিক শারীরিক প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে প্রচলন করা হয়। এটি বিকল্প ধারার চিকিৎসা কিংবা ন্যাচারোপ্যাথির অংশ না। কেটো ডায়েট নিউট্রাসিটিক্যাল উপাদানের উপর নির্ভরশীল না। এই ডায়েটে নিউট্রাসিটিক্যাল উপাদানের ব্যবহার একান্তই বিকল্প ধারার চিকিৎসকের নিজস্ব পরামর্শ।
অনলাইনে চলমান বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আপনার গঠনমূলক পর্যবেক্ষন কিংবা অভিমত আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবো। আমাদের পাঠাতে হবে [email protected]এই ঠিকানায়। অথবা যাচাই-এর ফেসবুক পেইজ-এ সরাসরি পাঠিয়ে দিতে পারেন।