এপ্রিল মাসের প্রথম দিন – তথা ‘এপ্রিল ফুল’, প্রতি বছর নানা কৌতুক ও ঠাট্টার মাধ্যমে সারা বিশ্বব্যাপী কমবেশি পালিত হয়ে থাকে। এই দিনের উৎপত্তি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন ঘটনা না জানা গেলেও প্রচলিত আছে বিভিন্ন ধারনা বা থিওরি। আসুন জেনে নেই এই দিবস পালনের পেছনে প্রচলিত কিছু ঘটনার ব্যাপারে―
রানী ইসাবেলার গ্রেনাডা দখল
এই দিনের উৎপত্তি সম্পর্কে বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রচারিত ধারণা হচ্ছে, রানী ইসাবেলার ত্রিশ লক্ষ মুসলমানকে মসজিদে বন্দী করে পুড়িয়ে মেরে “ফুল” বলার কাহিনী, যা দাবী করা হয় ঘটেছিলো ১৪৯২ সালের এপ্রিলের প্রথম দিনে। এই কাহিনীটির জানামতে সর্বপ্রথম অস্তিত্ব পাওয়া যায় ১৯৯৭ সালের ইংরেজিতে লেখা একটি চেইন ইমেইল ম্যাসেজে। এই কাহিনীটি বাংলায় বর্ণনা করা হয় এইভাবে―
সেদিন ছিল ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল ৷ দুর্ভাগ্য তাড়িত গ্রানাডাবাসী অসহায় নারী ও মাসুম বাচ্চাদের করুণ মুখের দিয়ে তাকিয়ে খ্রিষ্টানদের আশ্বাসে বিশ্বাস করে খুলে দেয় শহরের প্রধান ফটক ৷ সবাইকে নিয়ে আশ্রয় নেয় আল্লাহর ঘর পবিত্র মসজিদে ৷ শহরে প্রবেশ করে খ্রিষ্টান বাহিনী মুসলমানদেরকে মসজিদের ভেতর আটকে রেখে প্রতিটি মসজিদে তালা লাগিয়ে দেয় ৷ এরপর একযোগে শহরের সমস্ত মসজিদে আগুন লাগিয়ে বর্বর উল্লাসে মেতে ওঠে হায়েনারা ৷ লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু অসহায় আর্তনাদ করতে করতে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারায় মসজিদের ভেতর ৷ প্রজ্বলিত অগ্নিশিখায় দগ্ধ অসহায় মুসলমানদের আর্তচিত্কার যখন গ্রানাডার আকাশ-বাতাস ভারী ও শোকাতুর করে তুলল তখন রাণী ইসাবেলা হেসে বলতে লাগলো, ‘হায় এপ্রিলের বোকা! শত্রুর আশ্বাস কেউ বিশ্বাস করে?’ সেই থেকে খ্রিষ্টান জগত্ প্রতি বছর ১লা এপ্রিল আড়ম্বরের সাথে পালন করে আসছে- April Fool মানে ‘এপ্রিলের বোকা’ উৎসব ৷
অপর একটি সংস্করণে বলা হয়, মুসলমানদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে স্পেন ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য জাহাজে উঠিয়ে সমুদ্রের মাঝপথে জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও, অপর আরেকটি সংস্করণে দাবী করা হয়―
“স্প্যানিশরা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না, কেন মুসলিমরা পরাজিত হচ্ছে না। পরে, তারা বুঝল তাদের আল্লাহ ভীতি অনেক, তাই তারা সবসময় জয়ী। তাই তারা কৌশল করে সিগারেট ও অ্যালকোহল পানীয় প্রেরণ করে। সেগুলো পেয়ে আল্লাহ ভীতি ভুলে যায় মুসলিমরা। তাই ১ এপ্রিল তাদের পতন হয়।”
৭১১-১৪৯২ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত মুসলিমরা “আনদালুস” (বর্তমানে স্পেন ও পর্তুগাল) শাসন করে। এই সময় খৃস্টান গোষ্ঠী একাধিক যুদ্ধের মাধ্যমে স্পেন পুনর্দখলের চেষ্টা করে। অবশেষে এই শাসনের অবসান ঘটে ১৪৯২ সালে খৃস্টানদের “গ্রেনাডা” রাজ্য দখলের মাধ্যমে। [1]
গ্রেনাডা যুদ্ধ মুসলিমদের পক্ষে নেতৃত্ব দেয় গ্রেনাডার তৎকালীন শাসক পরিবার “নাসরিদ”-এর আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ XII (স্প্যানিশদের কাছে “বোয়াব্দি” নামে পরিচিত) এবং খৃস্টানদের পক্ষে নেতৃত্ব দেয় ক্যাস্টেলি সাম্রাজ্যের রানী ইসাবেলা I ও ফর্ডিন্যান্ড II। যুদ্ধটি শুরু হয় ১৪৮২ সালে এবং প্রায় ১০ বছর ধরে পরিচালিত হয়।
জানুয়ারি ২, ১৪৯২ তারিখে এই দীর্ঘ যুদ্ধের অবসান ঘটে আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ XII-এর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। [2] অর্থাৎ, “এপ্রিল ফুলের” প্রেক্ষাপটে প্রচলিত কাহিনী মতে এপ্রিল ১ তারিখে যুদ্ধ গড়াবার যে দাবীটি করা হয় তা ভিত্তিহীন কেননা জানুয়ারির ২ তারিখেই যুদ্ধের সমাপ্তি হয়। এছাড়াও ৩০ লক্ষ মানুষকে এইভাবে পুড়িয়ে মারার “নির্মম ও হৃদয় বিদারক ইতিহাস” অনলাইনের কিছু বেনামী পাতা ছাড়া কোন ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায় না। বিভিন্ন ইসলামি ইতিহাসবিদগণও এই গল্পটিকে “গুজব” বলে চিহ্নিত করেছেন। তবে ইতিহাসের বিভিন্ন উৎসে যুদ্ধ পরবর্তী স্পেনে মুসলমান ও ইহুদীদের উপর খৃস্টান ক্যাথলিক শাসকদের নির্যাতনের চিত্রের কথা উঠে আসে।
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রবর্তন
১৬শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপে বছরের হিসেব হতো এপ্রিলের এক তারিখ থেকে। এপ্রিল নামকরণ থেকেও ব্যাপারটা বোঝা যায়। ইংরেজি April শব্দটি এসেছে ল্যাটিন Aperire থেকে, যার অর্থ হল শুরু করা। পরবর্তীতে পোপ গ্রেগরি (Pope Gregory -Xiii) এপ্রিলের পরিবর্তে জানুয়ারির এক তারিখ থেকে বছরের ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন। অনেকেই তার এই পরিবর্তন মেনে নেয়নি। ফলে, লোকজন হাস্য-রসাত্মক কর্মকাণ্ড দিয়ে এপ্রিলের এক তারিখ পালন করা শুরু করে। যা ধীরেধীরে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
তবে ধারণা করা হয়, এ নিয়মের পূর্বেই ইউরোপে এপ্রিল ফুল ধারনাটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। এছাড়া গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় ১৭৫২ সালে। ফলে, ঠিক এই ক্যালান্ডারের কারণেই এপ্রিল ফুল শুরু হয় তা হলফ করে বলা যায়না।
রাজা জর্জ তৃতীয়-এর ক্ষমতাসমর্পন
অনেক ইতিহাসবিদ এপ্রিল ফুলের পেছনে ফরাসি বিপ্লবের সময় উল্লেখ করে থাকেন। ১৭৮৯ সালের ১লা এপ্রিল ফরাসী জনগণ রাজা লুইস ষষ্ঠদশকে (Lewis XVI) ক্ষমতাচ্যুত করে। রাজা লুইস দীর্ঘদিন চেষ্টা করেছিলো ইংরেজ সাম্রাজ্যের পতন ঘটাতে। কিন্তু রাজা লুইসের নিজেই ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় সে সময় ইংল্যান্ডের রাজা জর্জ তৃতীয় তাকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে – নিজে ক্ষমতাসমর্পনের নাটক করে। ইংল্যান্ডের সাধারণ কৃষকেরা এটিকে সত্য বলে মনে করে তাদের নতুন এই স্বাধীনতা উদযাপন করতে রাস্তায় নেমে আসলে তাদের গ্রেফতার ও কারাবন্দী করা হয়।
রোমানদের স্যাটারনালিয়া
এছাড়া পুরাণ মতে, রোমানরা স্যাটারনালিয়া (Saturnalia) নামক একধরণের উৎসব করত। যেখানে তারা শস্য দেবতা স্যাটার্নকে (Saturn) সন্তুষ্ট করত ভালো ফসলাদি পাবার আশায়। এ উৎসব চলতো ডিসেম্বর ১৯-২৫ তারিখ পর্যন্ত। এ সময় লোকেরা হত্যা, ধর্ষণ, ফসলাদি নষ্ট করা সহ অন্যান্য অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতো। স্বভাবতইঃ সকল ধরনের বিচারকার্য বন্ধ থাকতো। বর্তমান ইতিহাসবিদদের মতে, স্যাটারনালিয়ার সময় রোমান অধিপতিরা নির্দিষ্ট একজন নারী কিংবা পুরুষ নির্বাচন করে তার জন্য গোটা সপ্তাহজুড়ে পানাহার, যৌনকর্ম ইত্যাদি উন্মুক্ত করে দিত। পরবর্তীতে, ২৫শে ডিসেম্বর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করতো। এতে তারা মনে করতো তাদের সব পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গেছে। যাইহোক, ইতিহাসবিদরা মনে করেন, স্যাটারনালিয়া প্রথা পরবর্তীতে এপ্রিল ফুল হিসেবে হাসি তামাশার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপরের ঘটনাগুলো ছাড়াও “এপ্রিল ফুল”কে ঘিরে আরও নানা মুখরোচক ইতিহাস ভেসে বেড়ায়। যেসবের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কিংবা তথ্য আসলে পাওয়া যায়না। তবে মানুষজন এই দিনটিকে বহু বছর ধরেই উদযাপন করে আসছে। ফাঁকা চিঠি, শূন্য গিফট বক্স, বিব্রতকর খবর প্রচার সহ নানা অদ্ভুত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সারা বিশ্বের লোকজন এদিনটি পালন করে থাকে।
“এপ্রিল ফুল” পালন করা নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক প্রচলিত আছে, যার অধিকাংশই ধর্মীয় বিশ্বাস কেন্দ্রিক। “যাচাই”-এর কাজ কেবল তথ্যের সত্যতা তুলে ধরা কিন্তু কোন কিছুর ধর্মীয় বিশ্লেষণ করা আমাদের কার্যক্রমের আওতাভুক্ত নয় এবং আমরা সেটি করার উপযুক্ত পক্ষ না। “যাচাই” কোনভাবেই নির্দিষ্ট কোন সংস্কৃতি, ধারনা কিংবা বিশ্বাসকে পালন করতে বিশেষভাবে উৎসাহিত বা নিরুৎসাহিত করে না।
অনলাইনে চলমান বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আপনার গঠনমূলক পর্যবেক্ষন কিংবা অভিমত আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবো। আমাদের পাঠাতে হবে [email protected]এই ঠিকানায়। অথবা যাচাই-এর ফেসবুক পেইজ-এ সরাসরি পাঠিয়ে দিতে পারেন।