অনুসন্ধান

প্রথম প্রকাশ:

ক্যান্সারের ‘প্রাকৃতিক’ চিকিৎসা নিয়ে রয়েছে নানান বিতর্ক। এমনই একটি আলোচনা হচ্ছে ভিটামিন ‘বি১৭’ কেন্দ্রিক, যা আমিগড্যালিন(Amygdalin) বা লেইট্রিল (laetrile) নামেও পরিচিত। ক্যান্সারের এই প্রতিষেধকের দাবী অনেক বছর পুরনো হলেও, ইন্টারনেটের বদৌলতে ২০১৬ সালের দিকে এই দাবী ব্যাপক হারে ভাইরাল হয়। যা সাম্প্রতিক সময় জয় করেছে বাংলাদেশের ইন্টারনেট। বরাবরের মতই, কালের কণ্ঠের মত পত্রিকাগুলো, কোনরূপ যাচাই-বাছাই ছাড়া, বিদেশী আর্টিকেলের বঙ্গানুবাদ করে এই বিষয়ক খবর প্রকাশ করে এবং আগুন দেয় এই গুজবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ প্রকাশিত ১৪ জানুয়ারির সংবাদটি কপি করে, কালের কণ্ঠ প্রকাশ করে ঠিক দুইদিন পর।

কালের কণ্ঠের ১৬ জানুয়ারি তারিখের প্রতিবেদনে বলা হয়―

“ক্যান্সার কোনো রোগ নয় বরং ব্যবসার একটি ফাঁদ! সুতরাং ক্যান্সার বলে যে রোগের কথা বলা হয় তা একটি নির্জলা মিথ্যা। ক্যান্সার হলো মূলত ভিটামিন বি ১৭ এর ঘাটতি। ঠিক যেভাবে স্কার্ভি কোনো রোগ নয় বরং ভিটামিন সি এর ঘাটতি। অথচ স্কার্ভি রোগ নিয়েও জল কম ঘোলা হয়নি।

একটা সময়ে স্কার্ভি রোগ নিয়েও প্রচুর ব্যবসা করা হয়। পরে প্রমাণিত হয় স্কার্ভি কোনো রোগ নয়। ঠিক তেমনি ক্যান্সারও কোনো রোগ নয়। বরং দেহে একটি ভিটামিনের ঘাটতির কারণে এই সমস্যা দেখা দেয়।”

২০১৬ সালে newsrescue.com নামক ওয়েবসাইট এই পোস্ট প্রকাশ হলে তা অনলাইনে ভাইরাল হয়ে যায় নিমিষেই।

পত্রিকাটি তথ্যসূত্রে ‘হেলথভেইনস’ নামক একটি তথাকথিত স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইটের রেফারেন্স দিলেও, হেলথভেইনেস নামক ওয়েবসাইটের ঐ লেখাটি মূলত NewsRescue নামক একটি ওয়েবসাইটের ২০১৬ সালের একটি ভাইরাল পোস্টের কপি মাত্র।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিটামিন সি এর অভাবে যেমন স্কার্ভি রোগ হয়, তেমনি ক্যান্সারও ভিটামিন ‘বি১৭’ এর অভাবে হয়ে থাকে। এটি কোন রোগ না। ব্যবসায়িক স্বার্থে এটিকে রোগ বলে প্রচার করা হচ্ছে। আরও বলা হয়, যেহেতু এটি ভিটামিন বি১৭ এর ঘাটতি ঘটলেই হয়, সেহেতু প্রতিদিন এই ভিটামিন সমৃদ্ধ ফলমূল খেলে ক্যান্সার থেকে বাঁচা যায়।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব দাবী সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ও অপ্রমাণিত এবং ব্যবসায়িক উদ্দেশে ক্যান্সার রোগের প্রচার করা হচ্ছে বলা হলেও, ভিটামিন বি১৭ নামক এই তথাকথিত ভিটামিনের প্রচলনই করা হয়েছিল সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক স্বার্থে।

ভিটামিন বি১৭ কি?

বাংলা দৈনিকেও প্রচার করা হয় এমন সংবাদ।

ভিটামিন বি১৭ মূলত একপ্রকার কৃত্রিম ক্যামিকেল যা ‘লেইট্রিল (laetrile)’ নামে পরিচিত। আর্নস্ট ক্রেবস জুনিয়র নামক একজন ব্যক্তি এটির আবিষ্কারক। আমেরিকার খাদ্য ও ঔষধ অধিদপ্তরের (এফডিএ) নিয়ম পাশ কাটাতে, পরবর্তীতে লেইট্রিলকে তিনি ভিটামিন হিসেবে বি১৭ নামে নামকরণ করেন।[1] অথচ এই উপাদানে ভিটামিনের কোন বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় না। উপরন্তু এই ক্যামিকেলে এপ্রিকটসহ অন্যান্য কিছু ফলের শাঁস থেকে সংগ্রহীত ‘সাইনাইড’ বিষের উপাদান পাওয়া যায়।[2][3]

ক্যান্সার রোগের প্রতিষেধক হিসেবে এটি কাজ করে এমন দাবী করা হলেও, এর উপকারিতার কোন প্রমাণ এফডিএ খুঁজে পায়নি।[4] এমনকি আমেরিকার ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউট একাধিক পরীক্ষায়ও এমন কিছু পর্যবেক্ষণ করেনি। ফলে ১৯৭৭ সালের এক রিভিউতে, এফডিএ, বিষক্রিয়ার একাধিক রিপোর্টের ভিত্তিতে, ভিটামিন বি১৭ বা লেইট্রিল নিষিদ্ধ করে।[2]

ভিটামিন বি১৭ নামে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্বীকৃত কোন ভিটামিন নেই। অপরদিকে, এটি প্রাকৃতিক উপাদান, আমিগড্যালিন থেকে তৈরি করা এক প্রকার কৃত্রিম উপাদান। তাই আপেল, অ্যাপ্রিকোট, পিচ, পিয়ার্স ইত্যাদিতে ‘প্রাকৃতিকভাবে’ ভিটামিন বি১৭ থাকার দাবীটিও অযৌক্তিক।

ভিটামিন বি১৭ আবিষ্কারের ইতিহাস

আবিষ্কারক আর্নস্ট ক্রেবস জুনিয়র পেশায় ডাক্তার ছিলেন না। এমনকি বিজ্ঞান বিষয়ক কোন বিভাগে তার কোন ডিগ্রীও ছিলো না।[1] তিনি আমেরিকার একটি মেডিকেল কলেজে দুইবারে ১ম বর্ষ উত্তীর্ণ হওয়ার পর, ৩য় বছরে অকৃতকার্য হওয়ার জন্য কলেজ থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়। একাধিক কলেজে বিজ্ঞান বিষয়ক কোন ডিগ্রী অর্জন না করতে পেরে, তিনি অবশেষে বিএ পাশ করেন একটি ইউনিভার্সিটি থেকে।[1] তিনি তার পিএইচডি থাকার কথা দাবী করলেও, সেটি একটি বাইবেল কলেজ থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রী ছিলো মাত্র, যে কলেজটি পরবর্তীতে বন্ধ হয়ে যায়।

আমিগড্যালিন (Amygdalin) একটি প্রাকৃতিক উপাদান যা এপ্রিকটসহ আরও কিছু ফলে পাওয়া যায়। ১৯২০-এর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া-এ আর্নস্ট ক্রেবস জুনিয়র এর পিতা, আর্নস্ট ক্রেবস সিনিয়র, আমিগড্যালিন-এ ক্যান্সার তথা টিউমারের প্রতিষেধক গুণাবলী আছে বলে দাবী করেন। তবে এটি মানুষের জন্য খুবই বিষাক্ত বলে তিনি এটি ব্যবহার না করতেই পরামর্শ দেন।

আর্নস্ট ক্রেবস জুনিয়র ১৯৫২ সালের দিকে দাবী করেন যে তিনি বিষাক্ত ও ক্ষতিকর দিক বাদ দিয়ে বিশুদ্ধ আমিগড্যালিন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। আর এই উপাদানকেই নামকরণ করেন ‘লেইট্রিল’ হিসেবে। ১৯৫৩ সালেই ক্যালিফোর্নিয়া মেডিকেল এসোসিয়েশনে এটিকে অকার্যকর বলে ঘোষণা দেয়।[4]

লেইট্রিল বা ভিটামিন বি১৭ -এ মধ্যে কি ধরণের উপাদান আছে সেটির ব্যাপারে স্বচ্ছ কোন ব্যাখ্যা আর্নস্ট ক্রেবস দেননি। laevo-mandelonitrile-beta-glucuronoside নামক একটি উপাদানের উল্লেখ থাকলেও এই উপাদান লেইট্রিল বা ভিটামিন বি১৭ -এর ঔষধে পাওয়া যায়নি।[2] এমনকি লেইট্রিল হিসেবে বাজারজাতকৃত পণ্যগুলোর উপাদানের মাত্রা ও ধরণ একেক রকম হয়ে থাকে।

সায়েন্সের ষড়যন্ত্র নাকি কিছু ব্যক্তির প্রতারণা?

কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়―

“ক্যান্সার নিয়ে লেখা জি. এডওয়ার্ড গ্রিফিন এর বই ‘ওয়ার্ল্ড উইদাউট ক্যান্সার’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া সত্ত্বেও বইটি অন্য ভাষায় অনুবাদ করতে দেওয়া হয়নি। কারণ বইটিতে তিনি ক্যান্সার নিয়ে ব্যবসা না করে বরং বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিকে উৎসাহিত করতে বলেছেন।”

জি. এডওয়ার্ড গ্রিফিন মূলত একজন পলিটিকাল এক্টিভিস্ট যার মেডিকেল সাইন্সে কোন দীক্ষা নেই। অনলাইনের ভাইরালিটির কারণে ও গ্রিফিনের মত ব্যক্তি, যাদের সরাসরি ক্যান্সার কিংবা মেডিকেল সায়েন্সের উপর ডিগ্রী নেই, তাদের মাধ্যমে, ১৯৯৬ সালে আর্নস্ট ক্রেবস জুনিয়রের মৃত্যুর পরও, ক্যান্সারের চিকিৎসায় লেইট্রিলের ব্যবহারের অপপ্রচার বেঁচে আছে আজ অবধি। এমনকি আমেরিকায় এই ঔষধ নিষিদ্ধ হলেও, সেদেশে অনেকেই অন্যদেশ থেকে এই জাতীয় ঔষধ ক্রয় করছে।

‘ব্যবসায়িক স্বার্থে ক্যান্সার নামক রোগের উৎপত্তি করা হয়েছে’ – ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিকদের এমন দাবী হলে, তথাকথিত ভিটামিন বি১৭ এর বেলায় এটি সবদিক থেকেই যথার্থ।

মেডিনিউজ নামক একটি তথাকথিত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক ওয়েবসাইটেও পাওয়া যায় এই সংবাদটি।

স্কার্ভি রোগের সাথে তুলনা করলেও, এটি প্রমাণিত যে স্কার্ভি রোগ যেরকম ভিটামিন সি সেবনে ঠিক হয়ে যায়, সেরকমভাবে তথাকথিত ভিটামিন বি১৭ কিংবা এটি সম্বলিত ফলমূল খাওয়ার পরে ক্যান্সার নিরাময় হয় না। উপরন্তু আমিগড্যালিন সমৃদ্ধ খাদ্য খাওয়ার ফলে সাইনাইড বিষ তৈরি হয়ে মৃত্যুবরণের ঝুঁকি থাকে।[4]

ভিটামিন বি১৭ বিষয়ক লিফলেট

বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোর দায়িত্বজ্ঞানহীন অপপ্রচারের কারণে, এই গুজবের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে ফেসবুকে দিনাজপুর সরকারি কলেজে অনুষ্ঠিত, ‘ভিটামিন বি-১৭ ও ক্যানসার বিষয়ক’ একটি সেমিনারের তথ্য পাওয়া যায়। সেখানে এই বিষয়ক লিফলেটও প্রচার করা হয়।

মানুষও এসব ‘বিকল্প চিকিৎসা’ পদ্ধতিতে আকৃষ্ট হচ্ছে – এই রোগের সম্বন্ধে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার জন্য এবং সস্তায় চিকিৎসা লাভের আশায়। অথচ এসব ‘বিকল্প চিকিৎসার কার্যকারিতা বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত নয়। ক্যান্সারের মত সংবেদনশীল রোগের ব্যাপারে এসব অপপ্রচারের ফলে, মানুষ কার্যকর চিকিৎসা থেকে সরে গিয়ে ঝুঁকে পড়ছে অপচিকিৎসায়।

পাদটীকা

তথ্যসূত্র

  1. Benjamin Wilson, M.D.. "The Rise and Fall of Laetrile". Quackwatch. (জানুয়ারি ৭, ২০১৪).
  2. Department of Health, Education and Welfare. "Laetrile - The Commissioner's Decision". Food and Drug Administration. (আগস্ট ৯, ১৯৭৭).
  3. "Laetrile/Amygdalin". PubMed Health. (মার্চ ১৫, ২০১৭).
  4. "Laetrile: The Making of a Myth". Cancer Treatment Watch. (মার্চ ৫, ২০০৬).
  5. Laura J. Martin, MD. "Is Amygdalin a Safe Cancer Treatment?". WebMD. (অক্টোবর ১৫, ২০১৭).

মন্তব্য

দাবীটি প্রচারণার সময়কাল

প্রচারিত মাধ্যম

কোন মিডিয়া অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি? রিপোর্ট করুন