গুজবের উৎপত্তি
জানুয়ারি ৭, ২০১৭ তারিখে ‘ইউনিভার্সাল ভিশন’ নামক একটি ধর্মভিত্তিক ইউটিউব চ্যানেলের ‘শবে কদরের মূল মর্যাদার বিষয়টি কেমন?‘ শিরোনামে একটি ভিডিওতেও মুফতি কাজী মুহাম্মদ ইব্রাহীম শবে কদর বিষয়ক আলোচনায় এমন দাবীটি করেন। তার দাবী অনুসারে, মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা, নাসা একটি গবেষণার তথ্য বিগত ১০ বছর ধরে গোপন করে আসছে। তার ভাষ্যমতে, এই গবেষণায় নাসার বিজ্ঞানীরা দেখেছে যে বছরব্যাপী আকাশ থেকে প্রতি রাতে ১০-২০ লক্ষ উল্কা পৃথিবীতে পড়লেও নির্দিষ্ট একটি রাতে উল্কাপাত হয় না এবং সেটি হলো ইসলাম ধর্মালম্বিদের নিকট পবিত্র রাত লাইলাতুল কদর। তিনি উল্লেখ করেন বিজ্ঞানীরা মহাকাশ থেকে এই পর্যবেক্ষণে দেখেছে যে পৃথিবীর আকাশ এই রাতে সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকে।
মুফতি কাজী ইব্রাহীমের এই বক্তব্য উদ্ধৃতি দিয়ে দৈনিক যুগান্তরে মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ নামক একজন ব্যক্তি “নাসার গবেষণায় লাইলাতুল কদর” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধটি প্রকাশের পর এই গুজবটি ভাইরাল হয়ে পড়ে। সময়ের কণ্ঠস্বর নামক অনলাইন নিউজ পোর্টাল প্রবন্ধটিতে কিছু তথ্য সংযোজন করে তা পুনরায় প্রকাশ করে। সেখানে লেখা হয় হাফিংটন পোস্টে প্রকাশিত “Laylat Al Qadr ! What Is The ‘Night Of Power?’” শিরোনামে এক সংবাদের বরাত দিয়ে মুফতি কাজী ইব্রাহীম দাবীটি করেছেন। যদিও হাফিংটন পোস্টের বরাত দিয়ে তিনি দাবীটি করেননি এবং ঐ শিরোনামের প্রবন্ধে নাসা কিংবা উল্কাপাত সম্পর্কিত কোন আলোচনা করা হয়নি।[1] সময়ের কণ্ঠস্বরের এই সংস্করণ আরও একাধিক নিউজ পোর্টাল কপি-পেস্ট করে প্রচার করে।
সত্যতা যাচাই
বলার অপেক্ষা রাখে না নাসা থেকে এমন কোন প্রজ্ঞাপন বা বিবৃতি কখনো দেওয়া হয়নি এবং মুফতি কাজী ইব্রাহীমের ‘ইন্টারনেটে’ পাওয়া এই তথ্যের কোন অস্তিত্ব তার বক্তব্যের পূর্বে কোন মিডিয়ায় প্রকাশ হয়নি। তবে ২০১২ সালে ফেসবুকে ভাইরাল একটি কপি-পেস্ট পোস্টে “শবে কদরে উল্কাপাত হয় না” এমন দাবীটি পাওয়া যায়। যেখানে বলা হয়―
“লাইলাতুল কদর উজ্জল রাত্রি, খুব গরমও নয় খুব ঠান্ডাও নয়, এই রাত্রিতে উল্কাপাত হয় না।
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে নবীর (সা) বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত হয়েছে সহীহ ইবনে খুযায়মা, মুসনাদে তায়ালিসী গ্রন্থে । আলবানীর মতে সহীহ।”
উল্লেখিত হাদিস গ্রন্থ থেকে দেখা যায় মূল হাদিসে উল্কাপাত বিষয়ক কোন তথ্য উল্লেখ নেই। সেখানে লেখা―[2]
“এটি স্বচ্ছ ও নাতিশীতোষ্ণ রাত, এবং সকালের উদীয়মান সূর্য ইষৎ লাল বর্ণের হয়”
Ibn Khuzaymah. “Hadith 2192”. Sahih Ibn Khuzaymah.
ইসলাম ধর্ম অনুসারে শবে কদর বা লাইলাতুল কদর আরবি রমজান মাসের ২০ তারিখের পর বিজোড় রাতগুলোর যে কোন একটি হতে পারে।[7] অর্থাৎ, এই রাতটি সুনির্দিষ্ট না এবং এই নিয়ে ইসলামি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একাধিক মত প্রচলন আছে। অথচ মুফতি কাজী ইব্রাহীমের এই দাবী সঠিক হলে এটি প্রমাণিত হয় যে এই রাতটি নাসার বিজ্ঞানীরা সনাক্ত করতে পেরেছে। যা হয়নি।
এছাড়াও স্থানভেদে রাতের সময় ভিন্নতর হয়। অর্থাৎ, যেই সময় বাংলাদেশে শবে কদর সেই সময় আমেরিকায় শবে কদর হবে না। তাই যেহেতু উল্কাপাত শুধুমাত্র রাতে হয় না কিংবা নির্দিষ্ট সময়ে শুধু নির্দিষ্ট স্থানেই হয় না, তাই নির্দিষ্ট কোন রাতে উল্কাপাত না হওয়ার দাবীটি বৈজ্ঞানিকভাবে ভিত্তিহীন।
মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ২০১৭-তে ‘উল্কাপিন্ড’ আলোচনা
বাংলাদেশ ভিত্তিক রিয়েলিটি শো ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ২০১৭’-তে মুফতি কাজী ইব্রাহীমের এই গুজব সবচেয়ে আলোচনায় আসে। অনুষ্ঠানটির ৪র্থ পর্বে, একজন বিচারক একজন প্রতিযোগিকে প্রশ্ন করে, “৩৬৫ দিনের মধ্যে একদিন পৃথিবীতে ‘উল্কাপিন্ড’ হয় না, নাসার রিসার্চে। কোন দিনটি?”
Position Not Setউল্কাপাতকে ‘উল্কাপিন্ড’ বলায় বিষয়টি সেসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়। মুফতি কাজী ইব্রাহীম এই গুজবের প্রবর্তক হলেও সেসময় ঐ বিচারক এই গুজবের জন্য সমালোচনায় আসেন।
উল্কাপাত কি?
মহাকাশে রয়েছে অসংখ্য পরিভ্রমণরত পাথর বা ধাতু দ্বারা গঠিত ছোট মহাজাগতিক বস্তু। এই বস্তুগুলো বিভিন্ন গ্রহাণু (Asteroid) বা ধূমকেতু (Comet) ক্ষয় হওয়ার ফলে তৈরি হয়। এদেরকে উল্কা (Meteoroid) বলে। এসব উল্কা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করলে বায়ুর সংঘর্ষে জ্বলে উঠে। বায়ুর সাথে সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট এই আলোকে উল্কাপাত (Meteor) বলে, যা কেউ কেউ Falling Star-ও বলে থাকে। কিছু কিছু উল্কা একই উৎস হতে উৎপন্ন হয়ে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভেঙে প্রজ্বলিত হয় যাকে উল্কা বৃষ্টি বলা হয়।[3]
অধিকাংশ (৯০-৯৫%) উল্কা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় ভূপৃষ্ঠ আঘাত করার পূর্বেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।[4] এসব উল্কা দৈর্ঘ্যে ছোট ধূলিকণার সমান হওয়া থেকে ১ মিটার পর্যন্ত হতে পারে।[5] প্রতি বছর মোট উল্কাপাতের পরিমাণ কোন কোন গবেষণায় ওজনে পরিমাপ করলেও সংখ্যা নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব।[6] তাই, প্রতিদিন ১০-২০ লক্ষ উল্কা পৃথিবীতে পড়ে – কাজী ইবরাহিমের এই দাবীটিও ভিত্তিহীন। এছাড়াও ঐ আলোচনায় তিনি বলেন যে এই উল্কাপাতের মাধ্যমে ভূগর্ভে লোহার ঘাটতি পূরণ হয় – এই দাবীটিও অবৈজ্ঞানিক।
মুফতি কাজী ইব্রাহীমের অন্যান্য ভিত্তিহীন দাবী
মুফতি কাজী ইব্রাহীমের ইতিপূর্বেও আরও একাধিক অসত্য তথ্য বিভিন্ন বক্তব্যে পেশ করেছেন, যেসবের কয়েকটি হলো-
- ১। টেসটোসটেরন (testosterone) হরমোন পুরুষের পায়ের গোড়ালিতে উৎপন্ন হয় [ভিডিও]
- ২। বাতি জ্বালিয়ে ঘুমলে ক্যান্সার হয় [ভিডিও]
- ৩। কোমর ব্যথার কারণ টেসটোসটেরন নিঃসরণ [ভিডিও]
- ৪। কোকাকোলা, পেপসি ইত্যাদি পানীয়তে বিভিন্ন হারে এলকাহোল মেশানো থাকে [ভিডিও]
তার দাবী করা এসব তথ্যের পেছনে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণার কথা বলা হলেও এসব দাবীগুলো সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত।