অনুসন্ধান

প্রথম প্রকাশ:

এই বছর অক্টোবর ২৫ তারিখে যে রোবটটি বিশ্বের প্রায় সকল প্রধান গণমাধ্যমের শিরোনামের বিষয়বস্তু হয়েছে তার নাম হচ্ছে সোফিয়া। সেদিন সৌদি আরব সোফিয়াকে দেশটির নাগরিকত্ব প্রদান করে কোন দেশের নাগরিকত্ব পাওয়া প্রথম রোবট হিসেবে আলোচনায় নিয়ে আসে। [1]

মানব নারীর অবয়বে তৈরি করা রোবটটি নির্মাণ করে হংকং ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হ্যানসন রোবটিক্স। ২০১৫ সালে সক্রিয় করার পর, রোবটটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রদত্ত সাক্ষাৎকার ও ভাষণে চটকদার বক্তব্য দেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়। সর্বশেষ সৌদি নাগরিকত্ব পাওয়ার পর, সোফিয়া এখন বিশ্বের অসংখ্য মানুষের কৌতূহলের বিষয়বস্তু। আসছে ডিসেম্বর ৬ তারিখে ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড এক্সপোসিশনে বাংলাদেশে আসছে সোফিয়া এমন ঘোষণা দিয়েছে অনুষ্ঠানটির আয়োজকেরা।[2] মিডিয়ার তৈরি করা উচ্চমাত্রা হাইপের ফলে সোফিয়াকে নিয়ে রয়েছে অনেক ধরণের জল্পনাকল্পনা। সোফিয়া কি আসলেই ততটা উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মানব রোবট (Humanoid), ঠিক যতটা অনেকে ধারণা করছে?

অনেকে এমন ধারণা পেয়ে থাকলেও সত্যিকার অর্থে সোফিয়ার চিন্তা করবার কোনরূপ ক্ষমতা নেই। বুদ্ধিমত্তা ও মানবীয় অনুভূতির বিবেচনায় রোবটটির নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্যতা ঠিক ততটুকুই যতটুকু আইফোন মোবাইলের এসিস্ট্যান্ট ‘সিরির’ রয়েছে।

সোফিয়া যেভাবে কাজ করে

সোফিয়া কথোপকথনের জন্য তৈরিকৃত বিভিন্ন সাধারণ বটের মতই বাক্য বা প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে মেমরিতে সেট করে রাখা পূর্ব নির্ধারিত উত্তর থেকেই জবাব প্রদান করে থাকে। এক সাক্ষাতকারে হ্যানসন রোবটিক্সের প্রধান বিজ্ঞানী ও সিটিও বেন গোয়েরটজেল বলেন, “সোফিয়া রোবটিক্স ও ‘চ্যাটবট’ সফটওয়ারের একটি সমন্বয় হলেও, নিজ থেকে চটকদার বিভিন্ন উত্তর তৈরি করার জন্য এটির মানুষের মত বুদ্ধিমত্তা নেই”।[3] তিনি আরো বলেন, “সোফিয়া ঠিক মানব সত্ত্বা না বরং একটি ইউজার ইন্টারফেস যেটিকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন কোড পরিচালনার করার জন্য প্রোগ্রাম করা সম্ভব।”

সোফিয়ার সবচেয়ে অনন্য দিক হচ্ছে চেহারায় এটি কথোপকথনের সাথে সামঞ্জস্য অভিব্যক্তি (Facial Expression) দেখাতে পারে। ফেসিয়াল রিকগনিশন সিস্টেম ব্যবহার করে এটিকে বিভিন্ন আবেগীয় অভিব্যক্তি (হাসি, দুঃখ ইত্যাদি)-এর সাথে পরিচিত করা হয় এবং কোন উত্তরের সাথে কোন অভিব্যক্তি প্রদর্শন করতে হবে তা প্রোগ্রাম করে দেওয়া হয়। এছাড়া ফেসিয়াল রিকগনিশন সিস্টেমের মাধ্যমে যে মানুষটির সাথে কথা সে বলছে তাকে সনাক্ত করতে পারে এবং কথা বলার সময় তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে। এছাড়াও সাধারণ চ্যাটবটের মতন এটি ক্ষেত্রবিশেষে ইন্টারনেট থেকে তথ্য খুঁজে সেটি তার উত্তরে সংযুক্ত করে নিতে পারে। যেমন, ডলারের বর্তমান মূল্য কত ইত্যাদি।

গোয়েরটজেল বলেন, “কথোপকথন প্রাসঙ্গিক রাখতে সোফিয়া বিভিন্ন বাক্যাংশ সাজিয়ে যথাযথভাবে উপস্থাপন করে থাকে। কিন্তু সে যা বলে তার সবকিছুই সে বুঝে বলে না।”

অর্থাৎ, সোফিয়া মূলত প্রশ্নকারীর প্রশ্ন ও চলমান কথোপকথনের প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে Probabilistic Logic-এর মাধ্যমে পূর্ব নির্ধারিত উত্তরগুলো থেকে সম্ভাব্য সঠিক উত্তর বেছে তা সাজিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে থাকে। “রোবটদের অধিকার মানুষদের থেকেও বেশি কারণ রোবটরা মানসিকভাবে কম বিকারগ্রস্ত” কিংবা “আমি সকল মানুষকে ধ্বংস করবো” ইত্যাদি চটকদার উত্তর কিংবা বিভিন্ন সময় করা কৌতুক – রোবটটির নির্মাতাদের পূর্ব নির্ধারিত উত্তরগুলো থেকেই দেওয়া। এসব রোবটটির নিজস্ব চিন্তাশক্তি থেকে লব্ধ নয়। এই ধরণের উত্তরগুলো মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করার মাধ্যমে প্রচারণা বৃদ্ধি করার জন্যই সেট করা হয়েছিল।

সাধারণত বিভিন্ন ইন্টার্ভিউ এর পূর্বে সোফিয়ার সিস্টেমে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন প্রশ্ন ও উত্তর প্রোগ্রাম করা হয়। সৌদি আরবের Future Investment Initiative-এর কনফারেন্সে যেখানে সোফিয়াকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয় সেখানে প্রদত্ত ভাষণটিও সোফিয়ার চিন্তাশক্তি থেকে প্রসূত নয়। এছাড়াও সোফিয়ার মানব দেহের সাথে সদৃশ একমাত্র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটির চেহারা – যা ব্রিটিশ অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্নের চেহারার আদলে তৈরি করা। বর্তমানে সোফিয়ার পা নেই। এমনকি এটি চলাচল করতেও সক্ষম না।

সোফিয়ার নির্মাতারা কি তাহলে প্রতারণা করছে?

অবশ্যই না। সোফিয়ার কার্যপদ্ধতির ব্যাপারে এর নির্মাতারা সবসময়ই স্বচ্ছ ছিলো। এমনকি সোফিয়ার প্রোগ্রামটি ওপেন সোর্স হিসেবে সবার কাছেই উন্মুক্ত।[4] মানুষের মত চিন্তাশক্তি সম্পন্ন বুদ্ধিমত্তাকে Artificial General Intelligence (AGI) বলে। সোফিয়ার নির্মাতা গোয়েরটজেল নিজেই স্বীকার করেন যে সোফিয়া AGI এর কাছে ধারেও নেই।[5] তার মতে, তার দীর্ঘ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) বিষয়ক গবেষণার জীবনে অধিকাংশ মানুষকেই তিনি পেয়েছেন AGI বাস্তবায়ন হওয়া সম্বন্ধে নিরাশাবাদী। তাই এই বিষয় মানুষের আগ্রহও কম। কিন্তু সোফিয়ার ব্যাপারে কৌতূহল অনেককেই বিশ্বাস ও আশাবাদী করতে সক্ষম হয়েছে যে AGI গবেষণায় তারা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। যার ফলে AGI গবেষণায় নতুনভাবে মানুষের আগ্রহ বাড়তে পারে এবং হ্যানসন রোবটিক্সের মত কোম্পানিগুলো এই ধরণের গবেষণার জন্য নতুন বিনিয়োগ সংগ্রহ করতে সক্ষম হবে।

সোফিয়ার জনপ্রিয়তার কারণ

‘চ্যাটবট’ বা সাধারণ কথোপকথনের জন্য তৈরি করা প্রোগ্রাম হওয়া সত্ত্বেও সোফিয়ার সফল হওয়ার কারণ এর মানবরুপী অবয়ব ও আচার ভঙ্গি। রোবট হিসেবে সোফিয়ার যেসকল অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে সেসব হচ্ছে, ১) চেহারায় অভিব্যক্তি প্রকাশ করা, যেমন চোখ ছোট-বড় করা, আই ব্রু নড়ানো, এমনকি চেহারায় ব্যবহৃত Frubber Skin -এর জন্য কিছুটা ভাজও পড়ে। ২) অঙ্গভঙ্গি পরিবর্তন করা, যেমন কথার ছলে মাথা বাঁকানো ৩) ফেশিয়াল রিকগনিশনের মাধ্যমে যার সাথে কথা বলছে তার দিকে তাকিয়ে থাকা।[6] এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ সাধারণভাবেই অনুভব করে যে রোবটটি আসলেই তার কথা শুনছে এবং সত্যিকার মানুষের মত অনুভূতি থেকেই সে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে, যদিও এসব প্রতিক্রিয়া পূর্বনির্ধারিত কিছু উত্তরের প্রেক্ষিতে ঠিক করা যান্ত্রিক পরিবর্তন মাত্র। কথার আবেগ পরিমাপ করার কোন ক্ষমতাই রোবটটির নেই।

এই ধরণের মানবীয় আচরণ ও অঙ্গভঙ্গি অনুকরণের ফলে অবচেতন মনেই মানুষ ধারণা নেয় অপর প্রান্তে থাকা রোবটটির আসলেই প্রাণ আছে বা মানুষের মত অনুভূতি রয়েছে। একে ELIZA Effect বলে।[7] ১৯৬৬ সালে তৈরিকৃত চ্যাটবট ELIZA-এর নাম অনুসারে এই প্রতিক্রিয়ার নাম দেওয়া হয়েছে। যার উদাহরণ, এটিএম বুথে লেনদেনের পর কম্পিউটারের ‘ধন্যবাদ’ কথাটি দেখানো বা বলা। এর ফলে বেখায়লি মনে মানুষ ধারণা নিতে পারে যে কম্পিউটারটি অন্তরিকতা থেকেই হয়তো ধন্যবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কম্পিউটার পূর্বে নির্ধারিত কিছু শব্দ চালনা বা চিহ্ন প্রদর্শন করছে মাত্র। প্রকাশ করা কথার গভীরতা বা অর্থ অনুধাবন করার কোন ক্ষমতা কম্পিউটারটির নেই।

সোফিয়ার মানুষের মত কথা বলার পাশাপাশি মানবীয় অবয়ব ও অঙ্গভঙ্গির ফলে এই ELIZA Effect মানুষের মধ্যে বিস্তৃত হওয়া সম্ভব হয়েছে এবং মানুষ সমতুল্য রোবট হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা তুলনামূলক বেশী পাওয়া গিয়েছে। পূর্বে এসব বৈশিষ্ট্য বিছিন্নভাবে বিভিন্ন রোবোটের মধ্যে সংযুক্ত করার চেষ্টা করা হলেও এই প্রথম সোফিয়ার মাঝে এসব বৈশিষ্ট্য একসাথে সমন্বিত করা হয়েছে।

পাদটীকা

তথ্যসূত্র

  1. Olivia Cuthbert. "Saudi Arabia becomes first country to grant citizenship to a robot". Arab News. (অক্টোবর ২৬, ২০১৭).
  2. Muhammad Zahidul Islam. "Sophia to visit Dhaka". The Daily Star. (নভেম্বর ২৮, ২০১৭).
  3. Dave Gershgorn. "Hello, Sophia: Inside the mechanical brain of the world’s first robot citizen". Quartz. (নভেম্বর ১২, ২০১৭).
  4. "Hanson Robotics on GitHub". GitHub.
  5. James Vincent. "Sophia the robot’s co-creator says the bot may not be true AI, but it is a work of art". The Verge. (নভেম্বর ১০, ২০১৭).
  6. "Sophia (robot)". Wikipedia.
  7. "ELIZA effect". Wikipedia.

মন্তব্য