‘ডেইলি ইন্ডাস্ট্রি’ নামক একটি বাংলাদেশ ভিত্তিক পত্রিকা গত ২ জুলাই, “Bangladesh becomes 4th largest remittance source for India” শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিপোর্টটিতে দাবি করা হয়, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট ১০ বিলিয়ন ইউএস ডলার ভারতে পাঠানো হয়েছে। সংযুক্ত একটি চার্টের তালিকায় ১ম স্থানে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ২য় স্থানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ৩য় স্থানে রয়েছে সৌদি আরব, ৪র্থ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ এবং ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে, কুয়েত, কাতার ও যুক্তরাজ্য। এছাড়াও রিপোর্টটিতে দাবী করা হয় প্রায় ১০ লাখ ভারতীয় নাগরিক বর্তমানে বাংলাদেশে কর্মরত আছে।
২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে অর্জিত রেমিটেন্সের এমন পরিমাণের সত্যতা নির্ভরযোগ্য কোন সূত্রে খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর সাম্প্রতিক একটি প্রেস কনফারেন্সে ১০ বিলিয়ন রেমিটেন্স পাঠানোর বিষয়টি প্রকাশ করে। সিপিডির এমন প্রেস কনফারেন্সের খবর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অপরদিকে ২০১৫ সালে দি ডেইলি স্টারের ‘মতামত’ বিভাগে প্রকাশিত একটি অভিমতে এমন একটি দাবী খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে বলা হয় ভারতে রেমিটেন্স পাঠানোর উৎস হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ৫ম। [1] যদিও সেখানে কোন তথ্য উৎস উল্লেখ করা হয়নি।
এই বছরের এপ্রিলে ঢাকা ট্রিবিউনের এক প্রতিবেদনে রাজস্ব বোর্ডের অজ্ঞাতনামা এক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, প্রতিবছর ভারতে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের অধিক রেমিটেন্স যাচ্ছে এবং অবৈধ উপায়ে যাওয়ার কারণে সরকার প্রতিবছর রাজস্ব হারাচ্ছে।[2] কিন্তু এই রিপোর্টটিও ১০ বিলিয়ন ডলারের হিসাব সমর্থন করছে না।
বিশ্বব্যাংক এর রিপোর্টে প্রকাশিত ২০১৭ সালে ভারতের উপার্জিত রেমিটেন্সের পরিমাণ ও ‘ডেইলি ইন্ডাস্ট্রি’-এ প্রদত্ত তথ্যের তুলনা করলে চিত্রটি দাঁড়ায়―[3]
এখানে দ্রষ্টব্য যে আলোচ্য রিপোর্টে বাংলাদেশ ছাড়া অন্য সকল দেশ থেকে উপার্জিত রেমিটেন্সের পরিমাণ ও অবস্থান প্রায় কাছাকাছি। বাংলাদেশের অবস্থান ৪র্থ বলা হলেও বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্টে বাংলাদেশের অবস্থা ২৫ এবং রেমিটেন্সের পরিমাণ ০.১২৬ বিলিয়ন ডলার।
আরও একটু অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, প্রতিবেদনে উল্লেখিত অন্য দেশের উপাত্তগুলো মূলত ২০১৭ নয়, বরং ২০১৬ সালের বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট থেকে নেওয়া।[3] আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, প্রতিবেদক উপাত্তটি সরাসরি উইকিপিডিয়া পেইজ থেকে নিয়েছেন, যেখানে এখনও ২০১৬ সালের উপাত্ত দেওয়া রয়েছে।[4] এখানে দাবীকৃত ১০ বিলিয়ন ডলারের হিসাবটি ২০১৭ সালের বলা হলেও তা তুলনা করা হয়েছে পূর্ব বছরের উপাত্তের সাথে।
অপরদিকে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ১০ বিলিয়ন ডলার ভারতে যাচ্ছে অবৈধভাবে। অথচ এই ‘অবৈধ’ ১০ বিলিয়ন ডলার তুলনা করা হচ্ছে বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্টে প্রাপ্ত অন্য দেশের অফিসিয়াল উপাত্তের ‘বৈধ’ রেমিটেন্সের সাথে। যা অযৌক্তিক।
এখানে এটি সুস্পষ্ট যে প্রতিবেদক রিপোর্টটি করার সময় যথাযথ গবেষণা করেননি এবং রিপোর্টটির আকার দেওয়া হয়েছে জনসাধারণের মনোযোগ আকর্ষণ করা জন্যই।
ভিত্তিহীন রিপোর্টটি প্রকাশের পর স্বাভাবিকভাবেই অনেকেই মনে করে যে এই রেমিটেন্স প্রেরকরা বিভিন্ন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। অথচ, সিপিডিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয় যে এই রেমিটেন্স প্রেরকরা মূলত বিভিন্ন ফ্যাক্টরি, বিশেষত বাংলাদেশের গার্মেন্টসগুলোতে অবৈধভাবে কাজ করছে।
এই প্রতিবেদনে প্রদত্ত রেমিটেন্সের পরিমাণ ও বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা অনুসারে, এরা প্রত্যেকে গড়ে প্রতি বছর ১০,০০০ মার্কিন ডলার উপার্জন করছে। যা বাংলাদেশী টাকায়, ৮ লাখ টাকা সমপরিমাণ। এই হারে সাধারণত বাংলাদেশের কোন ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা শোনা যায় না।
অপরদিকে বিশ্ব ব্যাংকের ২০১৭ সালের তথ্যানুসারে ভারত সর্বোচ্চ রেমিটেন্স আয় করে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে (প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার) এবং সেখানে অবস্থানরত ভারতীয় নাগরিক রয়েছে ৩৩ লাখেরও বেশী।[5] এই হিসেবে এদের প্রত্যেকের গড় আয় দাঁড়ায় প্রায় ৪,০০০ ডলার। যা আলোচিত প্রতিবেদনের উপাত্ত অনুসারে বাংলাদেশ থেকে উপার্জিত গড় রেমিটেন্স থেকে প্রায় ৬,০০০ ডলার কম। বাংলাদেশ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থনীতির তুলনা করলে এটি বাস্তবতা বিবর্জিত।
ডেইলি ইন্ডাস্ট্রির প্রতিবেদন প্রকাশের পর একাধিক নিউজ পোর্টাল রিপোর্টটি বাংলা অনুবাদ করে প্রকাশ করে। এছাড়াও অনেকেই যাচাই-বাছাই ছাড়াই ফেসবুক পোস্ট তৈরি করে।
বাংলাদেশী ব্লগার পিনাকী ভট্টাচার্য এই তথ্যের ভিত্তিতে রেডিও তেহরানের বাংলা সাইটে একটি সাক্ষাৎকারও প্রদান করে। যা পরবর্তীতে সাইটটি সরিয়ে ফেলে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন―
“এখন সর্বশেষ হিসেবে বলা হচ্ছে- গতবছর ১০ বিলিয়ন ডলার আয়ের সুযোগ করে দিয়ে বাংলাদেশ ভারতীয়দের জন্য চতুর্থ বৃহৎ রেমিট্যান্স আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে অবৈধ পথে পাঠানো অর্থের হিসাব এর চেয়ে অরো বেশি বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।”
অথচ, ১০ বিলিয়ন ডলারের এই হিসেবটি অফিসিয়াল কোন উপাত্তে প্রাপ্ত তো নয়ই এবং ডেইলি ইন্ডাস্ট্রির প্রতিবেদন অনুসারে, এটিই মূলত অবৈধ পথে পাঠানো অর্থের হিসাব। এই সাক্ষাৎকারটি কিছু তথাকথিত নিউজ পোর্টাল কপি-পেস্ট করে প্রচার করলে আলোচ্য দাবীটি আরও প্রচারণার সুযোগ পায়।