‘এভিয়েশন নিউজ’ নামক একটি নিউজ পোর্টাল সেপ্টেম্বর ১১ তারিখ রাতে ‘দরজা ভেঙ্গে গেছে ড্রিমলাইনার আকাশবীণার’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। পরবর্তীতে ‘ঢাকা ট্রিবিউন’ তাদের ওয়েবসাইটে সেটি পুনপ্রকাশ করলে, সংবাদটি ভাইরাল হয়ে যায়। পরবর্তীতে ‘দি ইন্ডিপেনডেন্ট’ সহ আরও কিছু পত্রিকা রিপোর্টটি হুবহু রেখে ইংরেজিতে পুনপ্রকাশ করে।

স্ক্রিনশট: বামে, ভাইরাল প্রতিবেদনটি ঢাকা ট্রিবিউন তাদের বাংলা সংস্করণে হুবহু পুনপ্রকাশ করে। ডানে, একই দিনেই সন্ধ্যায় ঐ প্রতিবেদন পরিমার্জিত রূপে প্রকাশ করে তাদের ইংরেজি সংস্করণে। তবে প্রতিবেদনে অন্য উড়োজাহাজের অপর আরেকটি ঘটনার ছবি ব্যবহার করা হয়।
সংবাদে বলা হয়, সদ্য চালুকৃত বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার, আকাশবীণা সেপ্টেম্বর ১১ তারিখ সকাল সাড়ে ৮টায় সিঙ্গাপুরের একটি ফ্লাইটের পূর্বে, বিমানের ‘অদক্ষ’ প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান ‘সজোরে’ বিমানের দরজা ‘অন’ করতে গেলে, ভুল বাটনে চাপ দিয়ে ফেলেন। এর ফলে প্লেনের দরজা থেকে ‘রাফট’ নামক একটি অংশ খুলে পড়ে। সংবাদে উল্লেখ করা হয়, ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তাৎক্ষনিক ‘জোড়াতালি’ দিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া রাফট ম্যানুয়ালি লাগানোর চেষ্টা করা হয়। সেটি করতে ব্যর্থ হলে ঘটনাটি জানাজানি হয়ে যায়। পরবর্তীতে রাফট ছাড়াই ‘দেড় ঘণ্টা’ দেরীতে ফ্লাইটটি সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
সংবাদে দরজা ভেঙ্গে যাওয়ার দাবীটি সঠিক না এবং সম্পূর্ণ প্রতিবেদনে রিপোর্টারের উড়োজাহাজের কাঠামো ও কার্যপদ্ধতি কিংবা ‘রাফট’ সম্বন্ধে অজ্ঞতা সুস্পষ্ট। এছাড়াও এই সংবাদে বোয়িং ৭৭৭ সিরিজের বিমানের অপর এক প্লেনের ছবি ব্যবহার করে ভুল সংবাদটিকে বিশ্বাসযোগ্য করার চেষ্টা করা হয়েছে। যা পরবর্তীতে ‘এভিয়েশন নিউজ’ নামক নিউজ পোর্টালটি মুছে ফেললেও, একই ছবি ব্যবহার করে সংবাদ পরিবেশন করে ঢাকা ট্রিবিউন, বিডিমর্নিং-সহ আরও বেশ কিছু তথাকথিত নিউজ পোর্টাল।
রাফট (Raft) কী?
যাত্রীবাহী বড় উড়োজাহাজে সাধারণত কোন সংযুক্ত সিঁড়ি থাকে না। রাফট মূলত এক প্রকার বাতাস দিয়ে ফোলানো বাহন/কাঠামো যা জরুরি মূহুর্তে সিঁড়ির বিকল্প হিসেবে দুর্ঘটনায় পতিত উড়োজাহাজ থেকে বের হওয়ার জন্য রাখা হয়। বিশেষত যদি কোন প্লেন জরুরি ভাবে পানিতে অবতারণ করতে হয়, তখন রাফট বিস্তার করে Evacuation Slide হিসেবে যাত্রীগণ স্লাইডিং করে প্লেন থেকে দ্রুততার সাথে বের হতে সক্ষম হয় এবং পরবর্তীতে রাফট প্লেন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাসমান বোট হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

ছবি: দরজার পেছনে Evacuation Slide হিসেবে রাফট ছোট চারকোনা বক্সে আবদ্ধ রাখা হয় (বামে)। জরুরি মুহূর্তে এটি প্রসারণের মাধ্যমে প্লেন থেকে নামার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হয় (ডানে)।
প্লেনের দরজা ‘আর্মড’ অবস্থায় অসাবধানতাবসত খোলা হলে রাফট স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাথে সংযুক্ত পাম্প দ্বারা বাতাস পরিপূর্ণ হয়ে স্লাইড হিসেবে বের হয়ে যায়। এই ধরণের দুর্ঘটনাকে Inadvertent Slide Deployment (ISD) বলে। নিচের ভিডিওটিতে এমন একটি ঘটনার ধারণ করা হয়েছে।
Position Not Setআকাশবীণায় কী হয়েছিলো?
ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুরের বিজি-৮৪ ফ্লাইটের পূর্বে ‘আকাশবীণা’-এ যাত্রীদের খাবার সরবরাহ করার জন্য ‘ডিজআর্মড’ না করেই দরজা খোলা হলে, দরজার সাথে থাকা রাফট স্বয়ংক্রিয়ভাবে বের হয়ে যায়। পরবর্তীতে রাফটটি বিচ্ছিন্ন করে, যাত্রীদের নামিয়ে প্লেনের ক্ষয়ক্ষতির জন্য পরীক্ষা করা হয়। এই ধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত রাফট বিস্তরণে বড় ধরণের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকলেও, এই ঘটনায় রাফটটি বের হওয়া ছাড়া অন্য কোন ক্ষতি সনাক্ত করা যায়নি বিধায়, নির্দিষ্ট সময়ের ১৮ মিনিট দেরীতে প্লেনটি সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। অথচ, প্রতিবেদনে বলা হয় ফ্লাইটটি দেড় ঘণ্টা দেরী করেছিলো।
রাফট এমন কোন ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ না যা ‘জোড়াতালি’ দিয়ে গোপনে ম্যানুয়ালি লাগানো সম্ভব, যেমনটা আলোচ্য রিপোর্টে উপস্থাপন করা হয়েছে। রাফট একবার বাতাস দ্বারা ফোলানো হলে, পরবর্তীতে যথাযথ পরীক্ষানিরীক্ষা সাপেক্ষে আবার প্যাক করে ব্যবহার করা সম্ভব।
ঐ রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়,
“খুলে পড়া অংশটি প্রকৌশল বিভাগে নিয়ে যাওয়ার পর তারা সিঙ্গাপুরে ফ্লাইট বিলম্বে হলেও অপারেট করার সিদ্ধান্ত দেন। এসময়, দেখতে কিছুটা দৃষ্টিকটু লাগলেও নিরাপত্তা হুমকি নেই বলে বিমানের প্রকৌশল বিভাগ থেকে নিশ্চিত করা হয়।”
রাফট প্লেনে দরজার পেছনে ছোট একটি বাক্সে আবদ্ধ অবস্থায় থাকে। এটি ছাড়া প্লেনের বাহ্যিক রূপে কোন প্রকার পরিবর্তন দেখা যায় না। তাই এটির অনুপস্থিতিতে ‘দৃষ্টিকটু’ লাগা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
রিপোর্টটিতে উল্লেখ করা হয়,
“অন্যদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ব্যপারটি সন্দেহজনক। এই ঘটনার জন্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এবং বিমানটি ক্রয়ের সাথে যুক্ত থাকা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জবাবদিহীর আওতায় আনা উচিৎ। এই বিমানের জন্য বিভিন্ন যন্ত্রাংশ কেনাবেচায় কোন দূর্নীতি হয়েছে কিনা তাও তদন্ত করা উচিৎ’।”
উপরের বক্তব্যের মাধ্যমে উল্লেখিত তথাকথিত ‘এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ’-এর জ্ঞানও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তিনি মূল দুর্ঘটনার ব্যাখ্যা না করে, সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে গতানুগতিক অভিমত প্রদান করেছেন।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সংবাদ মাধ্যমে ভুল খবর প্রচার প্রসঙ্গে একটি প্রেস রিলিজ প্রকাশ করেছে।
অসাবধানতাবসত এই ধরণের রাফট বিস্তরণের জন্য বড় ধরণের দুর্ঘটনা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তা স্বত্বেও সারা বিশ্বব্যাপী এটি ঘটা খুব বিরল নয়। ২০০৭ সালের এক তথ্য মতে, এই ধরণের ভুলের কারণে এয়ারলাইন্স ইন্ডাস্ট্রিকে প্রতি বছর ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এটি প্রতিরোধে এখনো পর্যন্ত বিভিন্ন কার্যকরী উপায় বের করা চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।