গুজবের উৎপত্তি
সম্প্রতি কাতার ভিত্তিক টিভি চ্যানেল আল জাজিরা “All the Prime Minister’s Men” শীর্ষক একটি প্রতিবেদন সম্প্রচার করে। প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাগণের দ্বারা দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের দাবী তুলে ধরা হয়। এমন দাবীর প্রমাণস্বরূপ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক ইসরায়েল থেকে ইন্টারনেট ও মোবাইল মনিটরিং সরঞ্জামাদি ক্রয় করা হয়েছে এমন একটি তথ্য উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, যেখানে ইজরাইলের সাথে বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কই নেই, সেখানে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘নজরদারির’ জন্য দুর্নীতি করে দেশটির একটি কোম্পানি হতে মনিটরিং সরঞ্জামাদি ক্রয় করা হয়েছে। এই দাবীর বিপরীতে সেনাসদর দপ্তর একটি প্রতিবাদলিপি প্রকাশ করে।
আল জাজিরার এই প্রতিবেদনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল ‘সময় টেলিভিশন’ একটি ভিডিও ও অভিমত প্রকাশ করে, যার শিরোনাম, “বিভ্রান্তির কিছু নেই, বাংলাদেশের ঘরে ঘরে রয়েছে ইসরায়েলের যন্ত্রাংশ”। চ্যানেলটির সম্প্রচার ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রধান সালাউদ্দিন সেলিমের এই লেখায় উল্লেখ করেন যে—
“ইসরায়েলের যন্ত্রাংশ ছাড়া শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বই বলা যায় অচল। সামরিক বাহিনী ছাড়াও গত কয়েক দশক ধরেই বাংলাদেশে ইসরায়েলের যন্ত্রাংশ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে টেলিকমিউনিকেশন ডিভাইস, নেটওয়ার্কিং ডিভাইস, ট্রান্সমিটার কিংবা রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি সংক্রান্ত যন্ত্রাংশ, ডিফেন্সের সিকিউরিটি ডিভাইস, রাডার ডিভাইসের সিংহভাগই তৈরি হয় ইসরায়েলে।”
এই দাবীর প্রমাণস্বরুপ তিনি প্রযুক্তিভিত্তিক বেশ কিছু প্রসিদ্ধ কোম্পানির নাম উল্লেখ করেন এবং দাবী করেন যে এসব ইজরাইল ভিত্তিক কোম্পানি। আমাদের লেখা প্রকাশের আগে পর্যন্ত সময় টিভির আর্টিকেলটি ফেসবুকে ৪৪ হাজারের উপর লাইক, শেয়ার ও কমেন্ট পায়। এছাড়াও সময় টিভির অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে, ‘কোন দেশ থেকে যন্ত্রাংশ কেনা উচিত —তা দেখার দায়িত্ব আল জাজিরার নয়!’ শিরোনামে প্রকাশিত ইউটিউব ভিডিওটি ১.৭ লাখের মতো ভিউ পায়।
সত্যতা যাচাই
খুবই অগোছালো, অস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশিত এই অভিমতটিতে প্রদত্ত অধিকাংশ তথ্যই ভুল। এছাড়াও যুক্তি ও লেখার ভঙ্গীতে অভিমত প্রকাশকারীর আন্তর্জাতিক ব্যবসায় ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপারে অনভিজ্ঞতা প্রকাশ পায়।
চ্যানেলটির সম্প্রচার ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রধান সালাউদ্দিন সেলিম তার ভিডিও ও লেখায় যেসব কোম্পানিকে ইজরাইলি কোম্পানি বলে দাবী করেন সেসবের প্রকৃত তথ্য হচ্ছে নিম্নরূপ—
কোম্পানি | প্রতিষ্ঠাতা দেশ | হেডকোয়ার্টার | প্রতিষ্ঠাতা |
Cisco | যুক্তরাষ্ট্র | যুক্তরাষ্ট্র | Sandy Lerner (USA)
Leonard Bosack (USA) |
Junipar (ভুল বানান) Juniper Networks |
যুক্তরাষ্ট্র | যুক্তরাষ্ট্র | Pradeep Sindhu (USA) |
Motorola | যুক্তরাষ্ট্র | যুক্তরাষ্ট্র | Paul Galvin (USA) Joseph Galvin (USA) |
Hewlett-Packard (HP) | যুক্তরাষ্ট্র | যুক্তরাষ্ট্র | David Packard (USA) Bill Hewlett (USA) |
Oracle Corporation | যুক্তরাষ্ট্র | যুক্তরাষ্ট্র | Larry Ellison (USA) Bob Miner (USA) Ed Oates (USA) |
এসব কোম্পানি ইজরাইলে সক্রিয়ভাবে ব্যবসায় করলেও এসব কোম্পানি ইজরাইলে প্রতিষ্ঠিত বা মূল কার্যক্রম ইজরাইল থেকেই পরিচালিত হয় এমন দাবী সম্পূর্ণ অসত্য।
এছাড়াও HP সম্পর্কে আরেকটি ভ্রান্ত তথ্য এখানে উপস্থাপন করা হয় যাতে বলা হয় Hewlett-Packard (HP) এর পূর্ব নাম ছিলো Indigo আবার বলা হয় ২০০১ সালে Hewlett-Packard (HP) এই Indigo কে কিনে নেয়। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, HP প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় এবং Indigo হচ্ছে একটি প্রিন্টিং ও প্রেস সংক্রান্ত কোম্পানি যা ১৯৭৭ সালে ইজরাইলে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০১ সালে HP কোম্পানিটি কিনে নিলে তার নাম হয় “HP Indigo Division”, যা মূলত বাণিজ্যিক প্রেসের সরঞ্জাম ও কমার্শিয়াল প্রিন্টিং এর সমাধান প্রদান করে। HP এর ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহৃত প্রিন্টার এই কোম্পানি তৈরি করে না।
তার লেখায় তিনি দাবী করেন—
“মাইক্রোসফটের জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেম Windows NT এবং XP Operating Systems এর মূল ডেভেলপমেন্টের কাজটি হয়েছিল ইসরায়েলেই।”
এটি একটি বহুল প্রচলিত ভ্রান্ত দাবী। মাইক্রোসফটের উল্লেখিত এই অপারেটিং সিস্টেমগুলো সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা নিজস্ব প্রকৌশলী সমন্বিত প্রচেষ্টা। এখানে মাইক্রোসফট ইজরাইল টিমের গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকলেও মূল বা সিংহভাগ ডেভেলপমেন্ট তারাই করেছে এমন কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।[1]
এছাড়াও আরও দাবী করা হয়—
“যে মাইক্রোপ্রসেসরের আবিষ্কার সারাবিশ্বকে বদলে দিয়েছে সেই মাইক্রোপ্রসেসরও মূল কাজগুলো হয় ইসরায়েলেই। বর্তমানে ইন্টেলের মাইক্রোপ্রসেসর শিল্পে প্রায় ৭৮০০ জন ইসরায়েলি প্রকৌশলী কাজ করে। অর্থাৎ বলা যায়, বাংলাদেশে যত কম্পিউটার ও কৃত্রিমবুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন ডিভাইস ব্যবহৃত হয় তার মূল যন্ত্রাংশ এই মাইক্রোপ্রসেসরটির মূল কারিগররাও কিন্তু ইসরায়েলের।”
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মাইক্রোপ্রসেসরের নির্মাতা ইন্টেলে প্রায় ৪৫টি দেশের ৮৫ টি ফ্যাসিলিটির মাধ্যমে ১ লাখ ১০ হাজার ৬০০ জন কর্মরত আছে।[2] লেখাটিতে ইজরাইলে ৭,৮০০ কর্মচারীর সকলকে প্রকৌশলী দাবী করলেও, ২০১৪ সালের তথ্য অনুসারে ইজরাইলের ৪টি ডেভেলপমেন্ট ফ্যাসিলিটি ও ২টি উৎপাদন কেন্দ্রে ১০,০০ এর মতো লোক বিভিন্ন পদবীতে কাজ করে।[3] যা মোট জনশক্তির ১০% এর কিছু কম। এমন তুলনায় বাংলাদেশের সকল কম্পিউটার ডিভাইসের মূল যন্ত্রাংশগুলোর মূল কারিগরদের ইজরাইলের বলা অবান্তর।
অপর আরেক ভিত্তিহীন দাবী হচ্ছে—
“শুধু কমিউনিকেশন ইকুপমেন্টই নয়, বাংলাদেশে মেডিকেল সেক্টরে ব্যবহৃত ইমেজিং স্ক্যানিং সংক্রান্ত বেশিরভাগ যন্ত্রাংশই আসে ইসরায়েল থেকে।”
ইজরাইল থেকে সরাসরি বৈধ উপায়ে এসব সরঞ্জামাদি আনা সম্ভব নয়। এছাড়াও বিশ্বের শীর্ষ ৩০ মেডিকেল সরঞ্জামাদি নির্মাতা কোম্পানির মধ্যে কোনো ইজরাইলি কোম্পানি নেই।[4][5]
লেখকের অভিমতের পরিসমাপ্তিতে তিনি উল্লেখ করেন—
“তাছাড়া আমাদের দেশের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ কিংবা প্রযুক্তি কোন দেশ থেকে ক্রয় করা উচিত কিংবা অনুচিত তাও ধরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আল জাজিরার নয়, প্রয়োজনের স্বার্থে সরাসরি কিংবা ভায়া মাধ্যমে যেকোনো দেশের প্রযুক্তিই আমরা কিনতে পারি। সেক্ষেত্রে অন্যায়ের কিছু নেই।”
এমন একটি আনাড়ি অভিমতে লেখকের কূটনৈতিক আইন ও ব্যবস্থা সম্পর্কে অবিজ্ঞতা প্রকাশ পায়। যেখানে স্বয়ং ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী’ তাদের প্রতিবাদলিপিতে উল্লেখ করে—
“প্রতিবেদনটিতে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক ইসরায়েল থেকে ইন্টারনেট ও মোবাইল মনিটরিং সরঞ্জামাদি ক্রয় সংক্রান্ত মিথ্যা তথ্যের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য হাঙ্গেরির একটি কোম্পানি থেকে ক্রয়কৃত সিগন্যাল সরঞ্জামাদিকে উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে ইসরায়েল থেকে আমদানিকৃত মোবাইল মনিটরিং প্রযুক্তি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ক্রয়কৃত সরঞ্জাম কিংবা এ সংক্রান্ত কোন নথিপত্রেই এগুলো ইসরায়েলের তৈরি বলে উল্লেখ নেই। এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের সাথে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকায় উক্ত দেশ থেকে প্রতিরক্ষা সামগ্রী ক্রয় কিংবা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা গ্রহণের কোন অবকাশ নেই।”
এমন একটি নিম্নমানের অভিমত সময় টেলিভিশনের মত জাতীয় পর্যায়ের একটি গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ হতাশাজনক।