গুজবের উৎপত্তি
২০১৯ সালের আগস্ট ১১ তারিখে ঈদুল আযহার প্রারম্ভে জনৈক ইয়াসিন আলাউদ্দিন তার ব্যক্তিগত টাইমলাইনে “ইসলামিক পদ্ধতিতে জবাইতে পশু ব্যথা অনুভব করে না” এমন দাবী সম্বলিত একটি পোস্ট আপলোড দিলে তা ভাইরাল হয়ে পড়ে।
তার পোস্টে দাবী করা হয়, জার্মানির হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন প্রফেসর “ইসলামিক পদ্ধতিতে পশু জবাই করলে না কি ‘সিবিপি’ মেথডে স্টানড করে জবাই করলে পশু বেশি ব্যথা অনুভব করে” এই নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন।
গবেষণায় EEG (Electroencephalogram) দ্বারা পশুর মস্তিষ্ক এবং ECG (Electrocardiography) দ্বারা হৃদপিন্ড পর্যবেক্ষণ করা হয়।
জবাইয়ের প্রথম ৩ সেকেন্ডে EEG গ্রাফে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। যার অর্থ বলা হয়, “পশু কোনো ব্যথা পায় না”। এরপর উল্লেখ করা হয় যে, এসময়ের পর আরও ৩ সেকেন্ডের রেকর্ডে দেখা যায় পশু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকার মতো অচেতন হয়ে থাকে। যার ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়, “শরীর হতে প্রচুর রক্ত বের হয়ে যাওয়ায় ব্রেইনে রক্ত সরবরাহ হয় না বলে এই অচেতন অবস্থা হয়।”
এরপর বলা হয়, এই ৬ সেকেন্ডের পর EEG গ্রাফে ‘Zero level’ দেখাচ্ছিলো, যার ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়, “পশু কোনো ব্যথা পাচ্ছে না।” পরিশেষে উল্লেখ করা হয়, জবাইয়ের পর পশুর খিচুনি Spinal Cord এর একটি Reflex Reaction, এটি মোটেও ব্যথার জন্য হয় না।
তার উল্লেখিত তথ্যগুলোর অস্তিত্ব পাওয়া যায় The Daily New Nation নামক বাংলাদেশ ভিত্তিক একটি ইংরেজি পত্রিকায়। পত্রিকাটিতে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জনৈক সৈয়দ আশরাফ আলি-এর একটি লেখা প্রকাশ করা হয়, যার শিরোনাম “The most humane slaughter“। ধারণা করা যায়, ইয়াসিন আলাউদ্দিন তার তথ্যগুলো এই পত্রিকার আর্টিকেল থেকেই নিয়েছেন।
কপি-পেস্টের মাধ্যমে ইয়াসিন আলাউদ্দিনের পোস্টটি ২০১৯ সাল থেকে পরবর্তীতে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ঈদুল আযহার সময় নতুন করে ভাইরাল হয়। তবে একপর্যায় কপি-পেস্ট পোস্টগুলোতে ‘পশু’ শব্দের স্থানে ‘গরু’ শব্দ ব্যবহার শুরু হয়।
সত্যতা যাচাই
গবেষণাপত্রের প্রকৃত শিরোনাম
আলোচিত পোস্টগুলোতে যে গবেষণার উল্লেখ করা হয় সেটির অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। জার্মান ভাষায় লিখিত ঐ গবেষণাপত্রের ইংরেজি শিরোনাম হচ্ছে, “Objectivization of pain and consciousness in the conventional (dart-gun anesthesia) as well as in ritual (kosher incision) slaughter of sheep and calf”
এই শিরোনাম থেকে এটি বোধগম্য যে এটি ধর্মীয় পদ্ধতিতে জবাই বলতে সরাসরি মুসলমানদের জবাই পদ্ধতি নয়, বরং ইহুদী ধর্মালম্বিদের ‘কোশার’ পদ্ধতিকে উল্লেখ করেছে। অর্থাৎ, গবেষণাটি মূলত ‘ইসলামিক পদ্ধতিতে পশু জবাই’ এর উপর ছিলো এই দাবীটি সঠিক নয়।
ইয়াসিন আলাউদ্দিন ইসলামিক পদ্ধতিতে জবাইয়ের পক্ষে এই গবেষণাকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে যে লিংকটি প্রদান করে সেটি মূল জার্মান ভাষার গবেষণাপত্রটির ইংরেজিরূপ, যা ‘সাহিব মুসতাকিম ব্লেহার’ নামক একজন ব্রিটেন ভিত্তিক অনুবাদকের ভাষান্তরিত করা। তিনি ভাষান্তর করার সময় ‘কোশার’ (ইহুদীদের ধর্ম অনুযায়ী সঠিক) শব্দটি বদলীয়ে শিরোনাম করেন, “Experiments for the objectification of pain and consciousness during conventional (captive bolt stunning) and religiously mandated (“ritual cutting”) slaughter procedures for sheep and calves.”
এই গবেষণায় গরু নয়, বরং ভেড়া ও বাছুর ব্যবহার করা হয়।
উল্লেখিত EEG গ্রাফের বর্ণনার সত্যতা
ভাইরাল পোস্টে উল্লেখিত ৩ সেকেন্ড কিংবা ৬ সেকেন্ডের EEG গ্রাফের যে বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে সেটি প্রদত্ত গবেষণাপত্রের কোথাও পাওয়া যায়নি। এছাড়াও পশুর Reflex Reaction বিষয়েও সেখানে উল্লেখ করা নেই। দৈনিক নিউ ন্যাশন এর উল্লেখিত লেখাটি বাদে, এই বর্ণনার অস্তিত্ব পাওয়া যায়, অনুবাদক সাহিব মুসতাকিম ব্লেহারের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট mustaqim.co.uk-এ। যেখানে বলা হয়—
With the halal method of slaughter, there was not change in the EEG graph for the first three seconds after the incision was made, indicating that the animal did not feel any pain from the cut itself. This is not surprising. Often, if we cut ourselves with a sharp implement, we do not notice until some time later.
The following three seconds were characterised by a condition of deep sleep-like unconciousness brought about by the draining of large quantities of blood from the body. Thereafter the EEG recorded a zero reading, indicating no pain at all, yet at that time the heart was still beating and the body convulsing vigorously as a reflex reaction of the spinal cord. It is this phase which is most unpleasant to onlookers who are falsely convinced that the animal suffers whilst its brain does actually no longer record any sensual messages.
এথেকে বুঝা যাচ্ছে যে ‘দৈনিক নিউ ন্যাশন’ মূলত সাহিব মুসতাকিম ব্লেহারের এই লেখাটি থেকে হুবুহু তথ্য উঠিয়ে দিয়েছে। বাংলায় লিখা ইয়াসিন আলাউদ্দিনের পোস্টটি এই লেখার অনুবাদের প্রচেষ্টা মাত্র। যাতে ব্লেহারের ৬ সেকেন্ডের হিসেবগুলো স্বয়ং নিজের করা অনুবাদকৃত গবেষণাপত্রটি সমর্থন করে না, যদিও সেটিকে রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে তার ওয়েবসাইটে।
কী লেখা আছে অনুবাদকৃত গবেষণাপত্রে?
সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা জার্মান ভাষায় লিখিত মূল গবেষণাপত্রটি সংগ্রহ করতে পারিনি। তবে ভাইরাল পোস্টে রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখিত অনুবাদকৃত গবেষণাপত্রটির আলোকে নিচের তথ্যগুলো তুলে ধরা হলো।
গবেষণাপত্রটি জার্মানির হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন গবেষকের (W. Schulze, H. Schultze-Petzold, A.S. Hazem ও R. Gross)। গবেষণাটির উদ্দেশ্য ছিলো সেদেশে প্রচলিত ক্যাপটিভ বল্ট গান (Captive Bolt Pistol) দ্বারা মাথার নির্দিষ্ট স্থানে জোরে প্রহারের মাধ্যমে অচেতন করে পশু জবাই এবং সরাসরি ধর্মীয় পদ্ধতিতে ছুরির জবাই — এই দুইটির মধ্যে ব্যথা অনুভব ও অজ্ঞান হওয়ার মাত্রা নির্ধারণ করে তুলনামূলক একটি পরীক্ষা করা। গবেষণাটি করা হয় ১৯৭৮ সালে।
এই গবেষণায় গরু নয়, বরং ২৩টি ভেড়া ও ১৫টি বাছুর ব্যবহার করা হয় এবং গবেষণার পরিসমাপ্তিতে পূর্ণ বয়স্ক গরুর ক্ষেত্রে বিষয়টি কেমন হবে সেই বিষয় আলাদা গবেষণার জন্য অনুরোধ করে বলা হয়—
“They need to be followed as a high priority by further investigations in the continuation of the scientific clarification of the issues of loss of pain and consciousness during slaughter of this kind with and without stunning using the same experimental approach with a representative number of grown cows of various breeds.”
মস্তিষ্কের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য Electroencephalogram বা EEG ব্যবহার করা হয়। আমাদের মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকলে, সেটির কার্যক্রমের মাত্রা EEG গ্রাফে দেখা যায়, অনেকটা হৃদযন্ত্রের ECG (Electrocardiography) এর মতো।
আলোচিত গবেষণায় তুলনামূলকভাবে দেখা যায় যে জার্মানিতে প্রচলিত পদ্ধতি, অর্থাৎ অজ্ঞান করে পশুকে জবাই করা থেকে ধর্মীয় পদ্ধতিতে সরাসরি জবাইয়ে পশু তুলনামূলক তাড়াতাড়ি মস্তিষ্কের ক্রিয়া হারায়। অর্থাৎ, EEG গ্রাফে Zero Level-এ পৌছায় এবং পশু ক্লিনিক্যালি মৃত্যুবরণ করে।
গবেষণায় দেখা যায়, ক্যাপটিভ বল্ট গান দিয়ে প্রহারের ফলে EEG গ্রাফে মস্তিষ্কের কার্যক্রম বেশী পরিলক্ষিত হয়। যা ব্যথা অনুভব হওয়ার কারণেই হয় বলে উল্লেখ করা হয়। অপরদিকে, ধর্মীয় পদ্ধতিতে সরাসরি জবাইয়ে গলা কাটার পর EEG গ্রাফে তেমন কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়নি।
গবেষণায় বলা হয়, ক্যাপটিভ বল্ট গান দিয়ে প্রহারের মাধ্যমে অজ্ঞান করে পশু জবাই করার পদ্ধতি পালন করার কোনো কারণ এই গবেষণায় দেখা যায়নি। অপরদিকে, সরাসরি ধর্মীয় পদ্ধতি, যদি সঠিকভাবে পালন করা হয়, তবে সেটির মাধ্যমে পশু জবাই করা হলে, সেটি ভেড়া ও বাছুরের ক্ষেত্রে ব্যথাহীন, EEG গ্রাফ অনুসারে।
ইহুদীদের কোশার পদ্ধতিতে জবাই ও মুসলমানদের হালাল পদ্ধতিতে জবাই অনেকটা এক হওয়ায় উপরের এই গবেষণার উপসংহার তাই হালাল পদ্ধতিতে জবাইয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে।