গুজবের উৎপত্তি
সোশ্যাল মিডিয়ায় ডায়েট ও স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল পরামর্শের জন্য জনপ্রিয় ডাক্তার ড. জাহাঙ্গীর কবির জুন ১৫, ২০২১ তারিখে ‘রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই‘ শীর্ষক একটি ভিডিও প্রকাশ করেন ফেসবুক ও ইউটিউবে। প্রায় দুইঘন্টার আলোচিত এই ভিডিওর শেষাংশে ড. জাহাঙ্গীর কবির আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায় কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য ও ব্যাখ্যা প্রদান করেন।
ড. জাহাঙ্গীর কবিরের আলোচনাটি ভ্যাকসিন বিরোধী ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের পক্ষে প্রচলিত কিছু ভ্রান্ত ধ্যানধারণাকে সমর্থন করে বিধায়, সেটি তার সুবিশাল ফলোয়ার ও এন্টি-ভ্যাক্সিন চিন্তাধারার গোষ্ঠীর মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। ভিডিওতে উপস্থাপিত ভ্যাকসিন সংক্রান্ত তথ্যগুলো বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সমালোচিত হয়।
কঠোর সমালোচনার মুখে ভিডিওটি তিনি সম্প্রতি তার সোশ্যাল মিডিয়া পেইজগুলো থেকে মুছে ফেলেন। এর বিপরীতে জুলাই ২৭ তারিখে তিনি আরেকটি ভিডিও প্রকাশ করেন যেখানে তিনি তার অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন—
- ১) তার ভিডিওটি আংশিকভাবে প্রচার করে বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে।
- ২) ভিডিওটির উদ্দেশ্য ছিলো শুধুমাত্র ভ্যাকসিন এর উপর নির্ভর করে কোভিড-১৯ এর আক্রমণ প্রতিরোধ করা যাবে না —এটি বুঝানো।
- ৩) তার এই বক্তব্যকে ভিন্নভাবে প্রচার করা হচ্ছে।
- ৪) কথাগুলো সাধারণ মানুষের জন্য বোধগম্য ভাষায়, অর্থাৎ Layman’s terms-এ সাধারণ মানুষকে বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে, তাই এখানে ভ্যাকসিনের সম্বন্ধে পুংখানুপুংখ বর্ণনা দেওয়া হয়নি।
- ৫) ‘এন্টিজেন’ এর বদলে ‘এন্টিবডি’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে এরকম অপরিচিত শব্দ শুনে মানুষ ভ্যাকসিনের ব্যাপারে ভয় পেয়ে না যায় — এই ভেবে যে তার শরীরের ক্ষতিকর কিছু প্রবেশ করানো হচ্ছে।
- ৬) একপর্যায় তিনি ভ্যাকসিন কি ও কীভাবে কাজ করে সেটির ব্যাপারে ব্যাখ্যা প্রদান করেন।
নিজের অবস্থান সমর্থন করে এই ভিডিওতে ‘এন্টিজেন’ শব্দটি না বলার কারণ দর্শানো ছাড়া আলোচিত ভিডিওর অন্যান্য অংশের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য তিনি করেননি। তিনি বারবার বলার চেষ্টা করেছেন তার কথাগুলোকে ভুলভাবে কিংবা আংশিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
সত্যতা যাচাই
ড. জাহাঙ্গীর কবিরের আলোচিত ভিডিও প্রায় দুই ঘন্টার হলেও কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিয়ে তথ্যগুলো তিনি যে অংশে দিয়েছেন সেটির দৈর্ঘ্য সর্বমোট ১০ মিনিট। আমরা এই ১০ মিনিট অংশে মোট ১৮টি মুখ্য দাবী শনাক্ত করেছি।
১। আমাদের শরীরে রোগ জীবাণুর আক্রমণ হলে এন্টিবডি তৈরি হয়। এন্টিবডিগুলো মেমরি সেলে থেকে যায়। যে জীবাণুর আক্রমণ হয়, সেই জীবাণুর বিপরীতে এন্টিবডি তৈরি হয়। [ভিডিও]
রায়: সত্য
কোনো জীবাণুর আক্রমণে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধক সিস্টেম বা ইমিউন সিস্টেম আক্রমণকারী ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়াকে শনাক্ত করে সেটিকে মোকাবেলা করতে এন্টিবডি তৈরি করে।[1] মেমরি সেলে এন্টিবডি না থাকলেও, মেমরি সেল সেই এন্টিবডির সম্পর্কে তথ্য সংরক্ষণ করে থাকে।[2]
২। টিকার মাধ্যমে বাহির থেকে এন্টিবডি শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। [ভিডিও]
রায়: বিভ্রান্তিকর
যে ভাইরাসের জন্য টিকা প্রদান করা হয়, সেই ভাইরাসের এমন একটি সংস্করণ বা অংশবিশেষ টিকার মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করানো হয়, যা নিষ্ক্রিয় এবং প্রকৃত ভাইরাসের মতো দেহকে ক্ষতি করতে অক্ষম। ক্ষতি করতে অক্ষম হলেও এটি মূল ভাইরাসের শনাক্তযোগ্য এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।[3][4]
দেহে এটি প্রবেশের ফলে আমাদের রোগ প্রতিরোধক সিস্টেম সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবেই এই নিষ্ক্রিয় ভাইরাসকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে এন্টিবডি তৈরির মাধ্যমে এবং এই ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য ও এটিকে ধ্বংস করার জন্য সবচেয়ে উপযোগী এন্টিবডি কোনটি সেটি মনে রাখে।
পরবর্তীতে আসল ক্ষতিকারক ভাইরাস দেহে প্রবেশ করলে রোগ প্রতিরোধক সিস্টেম সেটিকে দ্রুত শনাক্ত করে, দ্রুত এন্টিবডি উৎপন্ন করে এবং ভাইরাসকে দ্রুত মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। কাজ শেষ হয়ে গেলে অন্য সব এন্টিবডির মতো এই এন্টিবডিও দেহ উৎপন্ন করা বন্ধ করে দেয়।
৩। কোভিড-১৯ মিউট্যান্ট ভাইরাস। মিউট্যান্ট ভাইরাস মানে প্রতিনিয়ত এই ভাইরাস তার বৈশিষ্ট্য বদলাচ্ছে। এর ফলে অনেক ‘স্ট্রেইন’ তৈরি হয়ে গিয়েছে এই ভাইরাসের। [ভিডিও]
রায়: বিভ্রান্তিকর
যেকোনো প্রাণীর মত, কেবল কোভিড-১৯ ভাইরাস না, বরং যেকোনো ভাইরাসই মিউটেট বা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়।[5] ভাইরাস মূলত অতিক্ষুদ্র জৈব কণা যেটি পোষক দেহে প্রবেশ করে, পোষক দেহকে ব্যবহার করে নিজের অনুরূপ (ক্লোন) তৈরি করে বংশ বিস্তার করে। এভাবে ভাইরাস নিজের অনুরূপ তৈরি এবং এক পোষক দেহ থেকে অন্য পোষক দেহে বিস্তার করতে করতে একপর্যায় ভুলের মাধ্যমে মূল মা-ভাইরাস থেকে সূক্ষ্ম পরিবর্তীত হয়ে যেতে পারে।
এই পরিবর্তন সে নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খেয়ে নেওয়ার মাধ্যমে নিজেকে আরও শক্তিশালী ও বিস্তারযোগ্য করার জন্য করে থাকে। এটিকেই ভাইরাসের মিউটেশন বা বিবর্তন বলে। এর মানে একটি ভাইরাস যতো বেশী ছড়াবে ও বংশবৃদ্ধি করার সুযোগ পাবে, সে ততো বিবর্তিত হবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পূর্বের চেয়ে আরও বেশী শক্তিশালী হবে।
কোভিড-১৯ নতুন একটি ভাইরাস, যা ক্রমাগত বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের জনগোষ্ঠীর মাঝে খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে। তাই এই ভাইরাসের বিবর্তন এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে এই বিবর্তন প্রক্রিয়ায় ভাইরাস নিজের এমন কোনো মূল বৈশিষ্ট্য হারায় না, যেটি তার অস্তিত্বকে হুমকি সম্মুখীন করবে।
৪। এন্টিবডি তৈরি করা হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ভ্যারিয়েন্ট বা স্ট্রেইন এর উপর। অন্য ভ্যারিয়েন্টের উপর এই টিকা কাজ করবে না। [ভিডিও]
রায়: অসত্য
যখন একটি ভাইরাস বিবর্তনের মাধ্যমে মা-ভাইরাসের থেকে কিছু সূক্ষ্ম পরিবর্তন অর্জন করে সেটিকে ‘ভ্যারিয়েন্ট’ বলে এবং এই পরিবর্তন যখন অনেক বেশী হয়, যেটির কারণে এটিকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়, সেটিকে তখন নতুন স্ট্রেইন বলে।[5][6] কোনো নির্দিষ্ট ভাইরাসের অসংখ্য, কোনো কোনো সময় শতাধিক বা হাজারের উপর, গঠনগত বৈশিষ্ট্য থাকে।
আমাদের দেহ টিকার মাধ্যমে কিংবা স্বাভাবিকভাবে কোনো ভাইরাসের আক্রমণে পড়লে, আমাদের রোগ প্রতিরোধক সিস্টেম ভাইরাসকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে এসব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করে। যেহেতু একটি ভাইরাস বিবর্তনের মাধ্যমে অল্প সময়ে তার সব বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে ফেলতে পারে না, তাই কোভিড-১৯ এর টিকা নতুন স্ট্রেইনের ভাইরাস মোকাবেলায় সম্পূর্ণ অকার্যকর হবে এমনটা বলা যায় না।
৫। ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক এন্টিবডি অনির্দিষ্ট এন্টিবডি। এটি যেকোনো ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার যে কোনো ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। [ভিডিও]
রায়: অসত্য
সকল এন্টিবডিই ‘সুনির্দিষ্ট’ রোগকে প্রতিরোধ করতে ‘প্রাকৃতিকভাবেই’ আমাদের শরীরের তৈরি হয়। টিকার মাধ্যমে এই এন্টিবডি তৈরির প্রক্রিয়াকে শুধুমাত্র উদ্দেশ্যমূলকভাবে কার্যকর করা হচ্ছে মাত্র, যাতে ক্ষতিকর ভাইরাস আক্রমণের পূর্বেই আমাদের দেহ সেটিকে চিনে নিতে পারে এবং সেটির আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকতে পারে। ফলে বেশী ক্ষতিসাধনের আগেই ভাইরাসকে সে নির্মূল করে ফেলতে পারবে।
আমাদের রোগ প্রতিরোধক সিস্টেম দুইটি ভাগে বিভক্ত।[7] ১) অন্তঃঅনাক্রম্যতন্ত্র (Innate immune system) ২) অর্জিত অনাক্রম্যতন্ত্র (Adaptive immune system)
‘ইন্নেট ইমিউয়ন সিস্টেম’ আমাদের প্রথম সারি প্রতিরোধক। যে কোনো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস কিংবা ক্ষতিকারক কোনো উপাদান দেহে প্রবেশ করলে এটি বিভিন্ন কোষ আক্রান্ত স্থানে পাঠিয়ে কিংবা প্রোটিন নিঃসরণের মাধ্যমে সেটিকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করে। এটি একটি অনির্দিষ্ট রক্ষক, অর্থাৎ, এটি যেকোনো ক্ষতিকর উপাদানকে মোকাবেলা করার চেষ্টা করে, সুনির্দিষ্ট একপ্রকার শত্রুকে না। এই পর্যায় এন্টিবডি উৎপন্ন হয় না।
‘ইন্নেট ইমিউয়ন সিস্টেম’ প্রাথমিক মোকাবেলায় জয় না করতে পারলে, শরণাপন্ন হয় এডাপ্টিভ ইমিউন সিস্টেমের কাছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের এই প্রতিরোধক সুনির্দিষ্ট আক্রমণের জন্য তখন এন্টিবডি উৎপন্ন করে। পূর্বেই নির্দিষ্ট শত্রুর ব্যাপারে তার জানা থাকলে, সে সুনির্দিষ্ট এন্টিবডি খুব তাড়াতাড়ি উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়। যদি এই শত্রুকে সে পূর্বে মোকাবেলা না করে, তবে সে যুদ্ধ করতে করতে সেই শত্রুর ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে যথাযথ এন্টিবডি উৎপন্ন করে।
৬। প্রাকৃতিক এন্টিবডির জন্য করোনা ভাইরাসে বাংলাদেশের ৮৫% মানুষের কোনো উপসর্গ পরিলক্ষিত হয় নাই। [ভিডিও]
রায়: অপ্রমাণিত
এমন কোনো উপাত্ত খুঁজে পাওয়া যায় না, যেখানে বলা হয়েছে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত ৮৫% ভাগ মানুষের মাঝে কোনোরূপ উপসর্গ দেখা যায়নি কিংবা আক্রান্তদের মধ্যে শুধুমাত্র ১৫% ভাগ মানুষের মধ্যে এই উপসর্গ পরিলক্ষিত হয়েছে।
৭। টিকার মাধ্যমে ঢুকানো ‘কৃত্রিম’ এন্টিবডি শক্তিশালী হওয়ায়, প্রাকৃতিক এন্টিবডিকে দখল করে। তাই টিকার এন্টিবডি শরীরের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতার জন্য হুমকি স্বরূপ। [ভিডিও]
রায়: অসত্য
টিকার মাধ্যমে শরীরের এন্টিবডি তৈরি করা হলে সেটি একই ভাইরাসের জন্য স্বাভাবিক উপায় উৎপন্ন এন্টিবডি হতে শক্তিশালী হয় এটি সত্য।[8] কিন্তু এন্টিবডি নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে না। বরং নির্দিষ্ট হুমকি শরীর থেকে সম্পূর্ণ মোকাবেলা করার পর এন্টিবডিগুলো শেষ হয়ে যায় এবং আমাদের দেহ সেটি উৎপন্ন করা বন্ধ করে দেয়।
৮। টিকা সফটওয়ারের মতো। একবার ইন্সটল করলে ডিলিট করা যায় না। [ভিডিও]
রায়: অসত্য
টিকা এমন কোনো বস্তু না যা দেহে অবস্থান করে কিংবা স্থায়ীভাবে দেহে ‘ইন্সটল’ করা যায়। টিকা কেবল একটি প্রক্রিয়া যেটির মাধ্যমে একটি ক্ষতিকর ভাইরাসের সম্বন্ধে তথ্য, রোগ প্রতিরোধক সিস্টেমকে প্রকৃত ভাইরাস আক্রমণের পূর্বেই জানিয়ে দেওয়া হয়।
আমাদের দেহ পূর্বে আক্রমণকারী সকল ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া মোকাবেলা করে প্রাকৃতিকভাবে এরূপ তথ্য তার তথ্যভাণ্ডারে সংরক্ষণ করে থাকে। পরবর্তীতে অনুরূপ ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে সেই তথ্য ব্যবহার করে সে দ্রুত সঠিক এন্টিবডি তৈরি করে শত্রুকে দ্রুত পরাস্থ করতে পারে।
৯। টিকার অকার্যকারিতা ও অন্য রোগের এন্টিবডির উপর এটির ক্ষতিকর প্রভাবের জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। [ভিডিও]
রায়: বিভ্রান্তিকর
যেসব কারণে টিকাকে অকার্যকর বলা হয়েছে সেসব কারণ ভিত্তিহীন। এছাড়া টিকা অন্য রোগের এন্টিবডি তৈরিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এটিও কল্পনাপ্রসূত তথ্য।
১০। বাংলাদেশে ভ্যাকসিন দেওয়ার পর মৃত্যুর হার বেড়ে গিয়েছে। [ভিডিও]
রায়: বিভ্রান্তিকর
বাংলাদেশে ভ্যাকসিন প্রদান শুরু হয় ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২১ তারিখে। সেই তারিখে মোট মৃত্যুর হার ছিলো ১.৫২%। গত জুলাই ২৭, ২০২১ তারিখ পর্যন্ত এই হার হয়েছে ১.৬৬%। এই ০.১৪ পয়েন্ট বৃদ্ধি ভ্যাকসিন প্রদানের জন্য বেড়েছে এমন দাবী বিভ্রান্তিকর।
জুলাই ২৮ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট টিকা গ্রহণ করেছে ৬৬ লাখের উপর মানুষ। শুধুমাত্র এই জনগোষ্ঠির মধ্যেই যদি এই মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেতো কিংবা সকল জনসাধারণ যদি টিকা গ্রহণ করতো তবেই তার যুক্তি এখানে কার্যকর হতো।
আক্রান্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় মৃত্যুর হারেও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটির সাথে ভ্যাকসিন প্রদানের সম্পর্ক নেই।
১১। ভ্যাকসিন দেওয়ার পর ভারতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এসেছে। ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ভাইরাস নিজের চরিত্র বদলাচ্ছে। [ভিডিও]
রায়: বিভ্রান্তিকর
ভারতের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রথম পাওয়া যায় ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে।[12] অথচ দেশটিতে টিকা প্রদান শুরু হয় প্রায় ১ মাস পর, ১৬ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে।[13]
ভাইরাসের বিবর্তনের চেষ্টার সাথে ভ্যাকসিনের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। বরং ভ্যাকসিনের মাধ্যমে এই রোগ সংক্রামণ দ্রুত প্রতিরোধ করা হলে এটি নতুন নতুন জনগোষ্ঠীতে গিয়ে বিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়। এভাবেই আমরা পোলিওর মতো ভাইরাল রোগ প্রতিরোধ করতে পেরেছি।
১২। ‘প্রাকৃতিক’ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো রাখতে গেলে আমাদের ব্যাকটেরিয়াকে ভালো রাখতে হবে। আমাদের শরীরে নিজস্ব কোষের সংখ্যার তুলনায় ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেশী। [ভিডিও]
রায়: বিভ্রান্তিকর
মানব শরীরে ভালো ব্যাকটেরিয়া মূলত খাদ্য হজমে সাহায্য করে।[9] কিছু রোগ প্রতিরোধক প্রোটিন তৈরিতে ব্যাক্টেরিয়ার খুবই গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা আছে।[15] এছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি ফাঙ্গাসের বিরুদ্ধে কাজ করে।[10] যেসব ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়াকে আক্রমণ করে, আত্মরক্ষার জন্য এটি ভাইরাসের সাথেও যুদ্ধ করে। তবে কোভিড-১৯ ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়া একে অপরকে আক্রমণ করে না।
আমাদের রোগ প্রতিরোধক সিস্টেম অসংখ্য ধরণের নিজস্ব কোষ ও প্রোটিনের সমন্বয়ে গঠিত। আমাদের শরীরের নিজস্ব কোষের সংখ্যা চাইতে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেশী।[14] তবে ব্যাক্টেরিয়ার আধিক্যের কারণে আমাদের প্রতিরোধক সিস্টেম এটির উপর সরাসরি নির্ভরশীল কিংবা আমাদের নিজস্ব কোষের তুলনায় ব্যাক্টেরিয়া এতে বেশী কার্যকর ভূমিকা রাখে —ব্যাপারটি এমন নয়।
১৩। আমরা ব্যাকটেরিয়া ছাড়া বাঁচতে পারবো না, ব্যাকটেরিয়া আমাদের ছাড়া বাঁচতে পারবে। [ভিডিও]
রায়: সত্য
খাবার হজমের জন্য প্রায় প্রতিটি প্রাণীই ব্যাকটেরিয়ার উপর নির্ভরশীল। মানবদেহের অবর্তমানে সেটি অন্য পোষক দেহ অবশ্যই পাবে কিন্তু ব্যাকটেরিয়া ছাড়া মানবদেহের স্বাভাবিক কার্যাবলী ঠিক রাখা সম্ভব নয়।
১৪। এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে শরীরের ব্যাকটেরিয়া মারা যায় বলেই আমরা দুর্বল হয়ে যাই। কারণ ব্যাক্টেরিয়া আমাদের রক্ষা করে। [ভিডিও]
রায়: বিভ্রান্তিকর
কিছু কিছু এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে আমরা দূর্বল অনুভব করতে পারি। অনেক সময় এটি কিছু এন্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে হয়, কিছু সময় অন্য ঔষধের সাথে প্রতিক্রিয়া করার জন্য হয়।
কোনোকোনো সময় এন্টিবায়োটিক কিছু উপকারী ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংস করে ফেলতে পারে।[10] ব্যাক্টেরিয়া যেহেতু আমাদের খাদ্য হজমে সহায়ক হিসেবে কাজ করে, এসব ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংসের ফলে আমাদের হজম শক্তিতে বিঘ্ন ঘটতে পারে। যার ফলে কোনোকোনো সময় আমরা দূর্বল অনুভব করতে পারি।
ভিডিওতে যেভাবে এককভাবে বলা হয়েছে ব্যাক্টেরিয়ার ‘রোগ প্রতিরোধক সুরক্ষা’ হারানোর ফলে আমরা দূর্বলতা অনুভব করি বিষয়টি ঠিক এমন না।
১৫। ভালো ব্যাকটেরিয়া কোভিড-১৯ এর মতো ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করে। এদের কারণে ভাইরাস শরীরে জায়গা করে নিতে পারে না, ভাইরাস খাবার পায় না। [ভিডিও]
রায়: অসত্য
এটি সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত। কোভিড-১৯ শরীরের কোষকে আক্রমণ করে, এটি ব্যাকটেরিয়ার সাথে কোনো আক্রমণে লিপ্ত হয় না। তাই ব্যাকটেরিয়ার এই ধরণের ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করার কোনো কারণ নেই। মানব শরীরের তুলনায় অতিক্ষুদ্র জৈবকণা ভাইরাস ও এককোষী ব্যাকটেরিয়া এতই ছোট যে সারা শরীর দখল করা এদের কারোর পক্ষেই সম্ভব না। এমন হওয়ার অনেক আগেই মানুষ মৃত্যুবরণ করবে।
ভাইরাস কোনোরূপ খাদ্যগ্রহণ করে না। এটি পোষক দেহের কোষকে আক্রান্ত করে সেই কোষ ব্যবহার করে বংশবৃদ্ধি করে।
১৬। হাত ধোয়ার ফলে হাতে থাকা ৯৯% ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলা হয়। এর ফলে কোভিড-১৯ এর মতো ভাইরাসের জন্য স্থান তৈরি হচ্ছে। [ভিডিও]
রায়: অসত্য
আমাদের হাতের সব কোষ বা জায়গা দখল করতে যে পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস প্রয়োজন পড়বে, স্বাভাবিক পরিবেশে সেই পরিমাণ অণুজীবের সংস্পর্শে আসা বাস্তবিক নয়। হাতে থাকা ব্যক্টেরিয়া, ভাইরাসের সাথে বাহ্যিক পরিবেশে এভাবে স্থান দখল করে মোকাবেলা করে এমন কোনো প্রমাণ নেই। বরঞ্চ হাতে থাকা এসব ব্যাকটেরিয়ার কিছু কিছু মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
১৭। সহজাত প্রবৃত্তির জন্য দিনমজুর জানে করোনায় তাদের কিছুই হবে না কারণ তাদের দেহ সেটিকে মোকাবেলা করতে সক্ষম। অপরদিকে সম্পূর্ণ আইস্যুলেশনে থেকেও অনেকে বাঁচতে পারে নাই। [ভিডিও]
রায়: বিভ্রান্তিকর
আইস্যুলেশনে থাকার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা হ্রাস পায়। যার ফলে এটি সংক্রামণ হওয়ার সুযোগ কম পায়। আইস্যুলেশন তখনই কাজ করবে যখন ব্যক্তির আশেপাশের সবাই সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানবে একইভাবে আইস্যুলেশনে থাকবে। যেসব ক্ষেত্রে তা করা হয়নি আইস্যুলেশন সেসব ক্ষেত্রে সুরক্ষা দেয়নি এবং যেহেতু আইস্যুলেশনে থাকা অধিকাংশই এই রোগে আক্রান্ত হয়নি, তাই আইস্যুলেশন অকার্যকর কিংবা অযৌক্তিক এমন দাবী সঠিক নয়।
সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ বিস্তারের প্রারম্ভে অনেক দেশ আইস্যুলেশন ও সোশ্যাল ডিস্টেনসিং চর্চার মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাধারণ জনগণ স্বাস্থ্যবিধি না মানায় কোভিড-১৯ বিস্তার হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। যার ফলে পূর্বের কম শক্তিশালী ভাইরাসটি বিবর্তনের সুযোগ পেয়ে, শক্তিশালী নতুন স্ট্রেইনে রূপান্তরিত হয়েছে।
১৮। কোভিড-১৯ থেকে বাঁচতে আমাদের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাকে ভালো রাখতে হবে। সুনির্দিষ্ট একটি উপাদান দিয়ে, যেমন শুধুমাত্র ভিটামিন খেয়ে, রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ঠিক রাখা যায় না। অনিয়ন্ত্রিত ও অস্বাস্থ্যকর খাবার আমাদের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতার জন্য ক্ষতিকর। [ভিডিও]
রায়: সত্য
ভ্যাকসিন আমাদের শরীরে কোভিড-১৯ এর এন্টিবডি তৈরিতে সহায়তা করে। এটি আমাদের সমগ্র রোগ প্রতিরোধক সিস্টেমের একটি ক্ষুদ্র কিন্তু গুরুত্বপূর্ন অংশ মাত্র। কিন্তু এই ভাইরাসের সাথে মূল যুদ্ধটা করে রোগ প্রতিরোধক সিস্টেম। সরাসরি ভ্যাকসিন নয়। যদি আমাদের দেহ যথেষ্ট এন্টিবডি তৈরি করতেই অক্ষম হয় এবং ভাইরাসের সাথে যুদ্ধের সময় শরীরের অন্যান্য কার্যক্রমের মাঝে ভারসাম্য রাখতে ব্যর্থ হয়, তবে ভ্যাকসিন এককভাবে কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষা দিতে সক্ষম হবে না। তাই ভ্যাকসিন নিলেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কার্যকর রাখা বাঞ্ছনীয় এবং এরা কেউ কারোর বিকল্প নয়।[11]
ড. জাহাঙ্গীর কবিরের প্রদত্ত যুক্তিতে অসংলগ্নতা
ড. জাহাঙ্গীর কবিরের দাবি অনুসারে তিনি ভিডিওটি তৈরি করেছিলেন সাধারণ মানুষের ভাষায় দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বৃদ্ধির গুরুত্ব বুঝাতে। যা বলতে গিয়ে তিনি এই ১৮টি পয়েন্ট নিয়ে এসেছেন। অথচ এসবের মধ্যে শুধুমাত্র ১৮নং পয়েন্ট বলাই যথেষ্ট ছিলো।
তিনি বাকি পয়েন্টগুলো বলে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার বদলে আরও বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলেছেন এবং তার সব পয়েন্টের আলোকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তার আলোচনার সারসংক্ষেপ হচ্ছে, “ভ্যাকসিন বা টিকা দেহের জন্য ক্ষতিকর এবং এটি ছাড়া আমরা কোভিড-১৯ এর মতো রোগ প্রতিরোধ করতে পারবো।” — যা সঠিক নয়।
তিনি দাবী করেছেন সাধারণ মানুষের জন্য বোধগম্য করতে তিনি এন্টিজেনের বতো কঠিন শব্দ ব্যবহার করেননি, অথচ স্ট্রেইন, ভ্যারিয়েন্ট, মিউট্যান্ট ভাইরাস, স্পেসিফিক এন্টিবডি, ন্যাচারাল এন্টিবডি — এই ধরণের খুবই টেকনিক্যাল শব্দ তার আলোচনায় উঠে এসেছে এবং সেসবের যথাযথ সংজ্ঞা প্রদান না করে সেসব ব্যবহার করে তার আলোচনা চালিয়ে নিয়েছেন।
তিনি তার পরবর্তী ভিডিওতে যদিও ভ্যাকসিনের সংজ্ঞা ও কার্যনীতি বর্ণনা করে এই ব্যাপারে তার জ্ঞান প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, তবে আলোচিত ভিডিওতে ভ্যাকসিন ও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কার্যনীতির ব্যাপারে মৌলিক পর্যায় তার অজ্ঞতাই প্রমাণিত হয়েছে এবং তার বক্তব্য আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক।
ভিডিওটির আংশিক অংশ, যেখানে ভ্যাকসিন নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেটি প্রচারের ফলে এর অর্থ পরিবর্তন হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি। উপরন্তু তিনি মূল ভিডিও মুছে ফেলায় সম্পূর্ন ভিডিও দেখার সুযোগও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

পরিশেষে তিনি ভুল স্বীকার করে ভুল তথ্যগুলোর সঠিক তথ্য না দিয়ে বারবার ‘আংশিকভাবে প্রচার’ বা ‘ভিন্নভাবে প্রচার’ করা হয়েছে বলে যে ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং এর মাধ্যমে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার যে চেষ্টা করেছেন, সেটি দুঃখজনক এবং ক্ষতিকর। এতে তার অনুসারীরা ভুল সংশোধন করার সুযোগ তো পায়ইনি বরং ভিডিওর কমেন্টে দেখা যায় অনেকে দাবী করছেন— তিনি সঠিক কথাই বলেছিলেন এবং বিভিন্ন মহল থেকে ‘চাপের কারণে’ এখন ভ্যাকসিনের পক্ষে কথা বলছেন।