আমাদের দেশে রোহমর্ষকভাবে প্রচারিত ‘নকল’ ডিমের রিপোর্টগুলোতে যে ফুটেজসমূহ ব্যবহার করা হয় সেসবের অধিকাংশই বিভিন্ন বেনামী ইউটিউব ভিডিও ক্লিপিংস থেকে নেওয়া। এসব রিপোর্টের প্রায় কোনটিতেই প্রমাণসহ নিজস্ব ফুটেজ ব্যবহার করা হয় নি।
এসব রিপোর্টে যে সকল বিশেষজ্ঞদের অভিমত নেওয়া হয়েছে তাদের কেউই নিজস্ব গবেষণায় ‘নকল’ ডিম পেয়েছেন এমন কোন তথ্য উল্লেখ করে নি। বরং, বিভিন্ন ভিডিও ও ব্লগে প্রচারিত ‘নকল’ ডিম বানানোর উপাদানগুলো কেন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তারা সেটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন মাত্র। ‘নকল’ প্রমাণের জন্য প্রয়োজন ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে কৃত্রিম উপাদানের উপস্থিতি পরিক্ষা করা। অথচ এই রিপোর্ট ও ভিডিওগুলো এই ধরণের পরিক্ষা এড়িয়ে গিয়েছে সুকৌশলে।
বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত ‘নকল ডিম’ বিষয়ক তথ্যগুলো খুবই অসামঞ্জস্য ও অসম্পূর্ণ। একটি নকল ডিম তৈরির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া, বিশেষত ডিমের কুসুম তৈরির পর তা কিভাবে খোলসজাত করা হচ্ছে এটি কোন ভিডিওতে দেখানো হয় নি।
বাজারে কোন ‘নকল’ ডিম নেই তা প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব, যেহেতু সেটির জন্য বাজারের প্রতিটি ডিম পরীক্ষা করে দেখতে হবে। তাই, ‘Process of Elimination’-পদ্ধতিতে বাজারে ‘নকল’ ডিম আছে’ – এমন দাবী যেসব রিপোর্টে বা মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে আমরা এখানে সেগুলোর ভিত্তি বিশ্লেষণ করছি।
পরিচ্ছেদসমূহ
- ১ ‘প্লাস্টিকের’ ডিম কেন বলা হয়?
- ২ ‘দ্যা ইন্টারনেট জার্নাল অব টক্সিকোলজি’ এর প্রতিবেদন
- ৩ “প্লাস্টিকের ডিম চেনার ৭টি উপায়”
- ৪ “কলকাতায় প্লাস্টিক ডিম বিক্রয়ের জন্য ১ জনকে গ্রেফতার”
- ৫ যমুনা নিউজের বিশেষ প্রতিবেদন
- ৬ “চট্টগ্রামের পটিয়ায় ‘নকল ডিম’ জব্দ করে পুলিশ”
- ৭ ‘নকল ডিম’ উৎপাদন ব্যবসায়িকভাবে কতটা লাভজনক?
- ৮ ‘নকল’ ডিম নাকি ‘নষ্ট’ ডিম?
- ৯ নকল না হলে এসব কেন হয়?
‘প্লাস্টিকের’ ডিম কেন বলা হয়?
কোন এক অজানা কারণে বাংলাদেশ ও বিশেষ করে ভারতে ‘নকল’ ডিমকে ‘প্লাস্টিকের’ ডিমও বলা হয়। অথচ এই ‘প্লাস্টিকের’ ডিমের প্রমাণস্বরুপ যে লেখা বা ভিডিও উল্লেখ করা হয় সেসবের কোনটিতে এটিকে ‘প্লাস্টিকের’ ডিম বলে উল্লেখ করা হয় নি। এমন কি এই ডিম তৈরিতে ‘প্লাস্টিকের’ কোন উপাদান ব্যবহৃত হয় এমন কথাও বলা হয় নি। ডিমের খোলস ছাড়ানোর পর ডিমের মেমব্রেনের স্তরটি একটু অস্বাভাবিক পুরু হলে অনেকে এটিকে নকল ডিমের ‘প্লাস্টিকের’ স্তর বলে দাবী করেছে। এমন অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যা এই লেখার শেষাংশে দেওয়া হয়েছে।
‘দ্যা ইন্টারনেট জার্নাল অব টক্সিকোলজি’ এর প্রতিবেদন
নকল ডিমের আলোচনাগুলোতে ‘দ্যা ইন্টারনেট জার্নাল অব টক্সিকোলজি’ এর একটি জার্নালের রেফারেন্স অনেক মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে। ‘আল্যাকজেন্ডার লি’ নামক একজন ব্যক্তির ২০০৫ সালে প্রকাশিত ঐ জার্নালটি মূলত অনলাইনে চলমান এই বিষয়ক অন্য সব রিপোর্টের মতই বিভিন্ন ইন্টারনেট ব্লগ ও রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে বানানো ছিল। এটি বৈজ্ঞানিক কোন গবেষণার উপর ভিত্তি করে নয়। ভলিউম ২, সংখ্যা ১ -এ প্রকাশিত ঐ রিপোর্টটি পরবর্তীতে ‘ভুল করে প্রকাশ করা হয়েছে’ বলে জার্নাল কর্তৃপক্ষ জানায় এবং ঐ লেখকের আরও একটি জার্নালসহ এটি মুছে ফেলা হয়।
“প্লাস্টিকের ডিম চেনার ৭টি উপায়”
দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত ‘প্লাস্টিকের ডিম চেনার উপায়গুলো’ মূলত ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘চায়না হাশ’ নামক চীন ভিত্তিক একটি ব্লগে প্রকাশিত তথ্যের হুবহু বঙ্গানুবাদ। [1] কেবল বাংলাদেশ নয়, অন্য দেশগুলোর বিভিন্ন রিপোর্টেও এই ব্লগকে মূল তথ্যসূত্র হিসেবে ট্রেসব্যাক করে পাওয়া যায়। অথচ এই ব্লগটি মূলত চীনা ভাষায় পরিচালিত একটি ফোরামের একটি পোস্ট থেকে ইংরেজিতে অনুবাদিত লেখা মাত্র।
দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশের পর ‘প্লাস্টিকের’ ডিম চেনার এই উপায়গুলো আরও বেশ কিছু পোর্টাল ও সোশ্যাল মিডিয়া পেইজে ‘কপি-পেস্ট’ হয়ে ভাইরাল হয়। এই থেকে বলা যায়, দৈনিক প্রথম আলোসহ অন্যান্য মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত এই উপায়গুলো মূলত ইন্টারনেট থেকে লব্ধ কিছু তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি। এসব প্রকাশের পূর্বে কোন প্রকার গবেষণা কিংবা বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করা হয় নি। অর্থাৎ, এসব তথ্য লোকমুখে শোনা কিন্তু গবেষণালব্ধ নয়।
“কলকাতায় প্লাস্টিক ডিম বিক্রয়ের জন্য ১ জনকে গ্রেফতার”
মার্চ ৩১, ২০১৭ তারিখে আনিতা কুমার নামক একজন মহিলার অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভারতের কলকাতায় শামিম আনসারি নামক একজন ডিম বিক্রেতাকে ‘নকল ডিম’ বিক্রয়ের জন্য পুলিশ গ্রেফতার করে।[2]
এই গ্রেফতারের ঘটনার পরপরই বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের বাজারেও ‘নকল’ ডিম প্রবেশ হচ্ছে বলে প্রচার শুরু করে। কলকাতার এই ঘটনাটি রিপোর্ট করে দি ডেইলি স্টার (বাংলা) “কলকাতার বাজারে ‘প্লাস্টিকের ডিম’, সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকছে বাংলাদেশেও!”- এই শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। অথচ মূল প্রতিবেদনের ভিতরে বলা হয় “আশঙ্কা করা হচ্ছে, সীমান্ত পেরিয়ে প্লাস্টিকের ডিম বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারে।” অর্থাৎ, একটি ‘আশঙ্কা’ শিরোনামে প্রচার করা হচ্ছে চলমান ঘটনা হিসেবে। তাও কোনরূপ তথ্য-উপাত্ত ছাড়া, শুধুমাত্র কলকাতা বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী বলে।
কলকাতার ঘটনাটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই সম্পূর্ণ অভিযানটি পরিচালনা করা হয়েছে আনিতা কুমারের একটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে। তার ক্রয়কৃত কয়েকটি ডিম ‘প্লাস্টিকের’ বলে তিনি সন্দেহ করেন কেননা ডিমগুলোর খোলস পুড়িয়ে তিনি প্লাস্টিকের গন্ধ পেয়েছিলেন।
গ্রেফতারকৃত ব্যবসায়ী শামিম আনসারির পাইকারি বিক্রেতাসহ অন্যান্য কিছু দোকানী থেকে পুলিশ কয়েক বাক্স ডিম জব্দ করে পরীক্ষণের জন্য। এটি কোন ‘গোপন তথ্যের’ ভিত্তিতে পরিচালিত ‘সাড়াশি অভিযান’ ছিল না। অথচ দি ডেইলি স্টারের রিপোর্টে বলা হয়,
“গোয়েন্দাদের প্রাথমিক জেরায় শামীম আনসারির দেওয়া তথ্য পেয়ে শিয়ালদহের ডিম পট্টিতে গিয়ে বেশ কয়েকটি দোকানে হানা দিয়ে বিপুল পরিমাণ ‘নকল ডিম’ উদ্ধার করে পুলিশ।”
এছাড়াও ‘সময়ের কন্ঠস্বর’ তাদের রিপোর্টেও উল্লেখ করে,
“ভারতের কলকাতার কয়েকটি বাজার থেকে প্লাস্টিকের (নকল) ডিম জব্দ করেছে পুলিশ।”
যমুনা টিভি তাদের রিপোর্টে বলে,
“কলকাতার বেশ ক’টি বড় বাজার , শিয়ালদহের ডিম পট্টি ও বর্ধমান থেকে উদ্ধার হয়েছে বিপুল নকল ডিম”…”প্লাস্টিকের ডিম সহ গ্রেফতার হন কয়েকজন ব্যবসায়ী। তাদের দেওয়া গোপন তথ্যের ভিত্তিতেই শিয়ালদহের ডিম পট্টিতে চালানো হয় সাঁড়াশী অভিযান। উদ্ধার হয় বিপুল সংখ্যক নকল ডিম।”
অর্থাৎ, ডিম ‘নকল’ কিনা ‘আসল’ সেটি ল্যাব রিপোর্টে আসার আগেই এই মিডিয়াগুলো সিদ্ধান্ত প্রদান করেছে যে এসব ‘নকল ডিম’। এছাড়াও এই ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে মূলত ১ জন যেখানে যমুনা টিভি উল্লেখ করেছে একাধিক ব্যবসায়ীর কথা। ‘আন্তর্জাতিক ডেস্ক’ কিংবা ‘পশ্চিমবঙ্গ/কলকাতা প্রতিনিধি’ ইত্যাদি উল্লেখ করা থাকলেও এই রিপোর্টগুলোর তথ্যের ধরণ পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় এসব মূলত ভারতের বিভিন্ন অনলাইন গণমাধ্যমে প্রচারিত রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও ফুটেজের উপর নির্ভর করে তৈরি করা।
উল্লেখ্য, ঘটনার প্রায় ৪ দিন পর, এই বিষয় গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্টে সংগৃহীত নমুনায় ‘নকল’ বা ‘প্লাস্টিকের’ ডিম বলা যায়, এমন কোন আলামত পায় নি বলে জানায়।[3] ইতিপূর্বে ২০০৮ সালে ভারতের তামিলনাড়ু এবং কেরালায় এরকম ‘নকল’ ডিমের গুজব উঠলেও অনুসন্ধানে সেসব কেবল পচা ডিম বলে সনাক্ত করা হয়। [4][5]
দুঃখের বিষয় এই যে, শূধুমাত্র আমাদের দেশের নয়, এমনকি ভারতের গণমাধ্যমগুলোও তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ততটা ফলাওভাবে প্রচার করে নি যতটা তারা ‘নকল’ ডিম পাওয়ার ঘটনাটি করেছিলো।
যমুনা নিউজের বিশেষ প্রতিবেদন

Jamuna News: “ডিমেও ভেজাল: ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড ও অন্যান্য পদার্থ দিয়ে তৈরি”
এপ্রিল ১৭, ২০১৬ তারিখে যমুনা টিভিতে বাংলাদেশের বাজারে নকল ডিম পাওয়া যাচ্ছে এই মর্মে একটি প্রতিবেদন প্রচার করা হয়। ১) প্রতিবেদনের শুরুতেই প্রতিবেদক বাজার থেকে ২টি ডিম সংগ্রহ করে নিয়ে যায় কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটে। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর, একজন কৃষিবিজ্ঞানী দুইটি ডিমের একটি ডিম আসল ও অপরটি নকল হিসেবে সনাক্ত করেন। ২) তিনি উল্লেখ করেন, ‘নকল’ ডিমের মধ্যে পচনশীল উপাদান যেমন এ্যালবুমেন দেওয়া হয় এবং দীর্ঘদিন সংরক্ষণ ও গন্ধরোধের জন্য প্রিজারভেটিভ দেওয়া হয়। এমনকি নকল খোলস তৈরি করে রং করার পর, ‘নকল’ ডিম বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য ডিমের গায়ে কৃত্রিমভাবে ময়লা বা রক্ত লাগিয়ে দেওয়া হয়। ৩) রিপোর্টের পরবর্তী পর্যায় ‘ইন্টারনেট খুঁজে’ প্রতিবেদক কথাগুলোর সত্যতা পায় বলে উল্লেখ করেন এবং ৪) বলেন যে সরাসরি ‘ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড’ ও ডাই দিয়ে কুসুম তৈরি করা হয়। আরও বলা হয় ৫) “খালি চোখে পার্থক্য বোঝা না গেলেও বাল্বের আলোয় ‘নকল’ ও ‘আসল’ ডিমের পার্থক্য পরিষ্কার- যেখানে ভেতরটা ঘন কালো দেখায় এবং খোলসটা তুলনামূলক নাজুক হয়।” ৬) ডিমের পাইকারি বাজারে খবর নিয়ে প্রতিবেদক ‘নকল’ ডিম পাচারকারীদের একজনের ইন্টারভিউ নেন। পরিশেষে প্রতিবেদক বলেন, ৭) “২০০৪ সালে চীনে প্রথম কৃত্রিম ডিম তৈরি হয় এবং বিভিন্ন চাপের মুখে তা বন্ধ হয়ে যায় এবং ৮) এখন সেসব ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। ৯) আশার কথা হচ্ছে, এর ব্যাপকতা এখনো বাংলাদেশে এতটা বেশি নয়। তাই পরামর্শ হচ্ছে শুরুতেই যাতে এর আগমনটা বন্ধ করে দেওয়া যায়। এজন্য সচেষ্ট হতে হবে কর্তৃপক্ষকে।” ১০) পরবর্তী অংশে সাধারণ ডিমেও কিভাবে ক্ষতিকর উপাদান যোগ করা হচ্ছে সেই বিষয় আলোকপাত করা হয়।
এই প্রতিবেদনের বিশ্লেষণ
১) পরিসংখ্যানের ভাষায় সাধারণ দৈব চয়ন পদ্ধতিতে, বাংলাদেশের কোটি কোটি ডিমের মধ্য থেকে এক চেষ্টায় দুইটি ডিম সংগ্রহ করা হলে সেসবের একটি আসল ও অপরটি নকল হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি কিন্তু হ্যাঁ, অবশ্যই অসম্ভব না। তবে এখানে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, ‘নকল’ সনাক্তকরণের প্রক্রিয়াটি কি ছিল তা পরিবেদনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয় নি। প্রতিবেদনের বিজ্ঞানী যদি কোন প্রকার ল্যাব টেস্ট ছাড়াই খোলা আকাশের নিচে, ডিম হাতে ধরেই বলে দিয়ে থাকেন ডিমটি নকল, তাহলে এই সনাক্তকরণ পদ্ধতিটি অবশ্যই অবৈজ্ঞানিক ও প্রশ্ন করার সুযোগ রাখে। বিশেষত যেখানে অনলাইনে এই প্রসঙ্গে প্রকাশিত লেখাগুলো এই ধরণের ডিম সনাক্ত করা ‘কঠিন’ বলে দাবী করে। অবশ্য পরবর্তী একটি প্রতিবেদনে একই প্রতিবেদক এটিকে ‘Physical Test’ হিসেবে অবহিত করেন।
২) নকল ডিমে এলুবমিন বা পচনশীল কিছু ব্যবহার করা হয় এমন কিছুই অনলাইনে কোন ‘নকল ডিম তৈরি প্রণালীতে’ উল্লেখ করা হয় নি। নকল ডিমে রক্ত ও ময়লা লাগিয়ে আসলের কাছাকাছি রূপ দেওয়া হয় – এই তথ্যটিও নতুন। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, ১) এ্যালবুমেন বা পচনশীল কিছু ব্যবহার কেন করা হবে এবং ২) একজন ব্যবসায়ী ডিমের মত একটি সস্তা পণ্যের জন্য এত কষ্ট কেন করবে?
৩) প্রতিবেদক ইন্টারনেট খুঁজে সত্যতার প্রমাণ পেয়েছেন বলে যে ভিডিও ফুটেজগুলো দেখায় তা মূলত ইউটিউবে ‘Fake Egg’ লিখে সার্চ দিলে প্রথম পৃষ্ঠার ফলাফলগুলোর ক’টি। যেসব আপলোড করা হয়েছে কিছু বেনামী চ্যানেল থেকে।
৪) ‘ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড’ এর মত শক্ত উপাদান দিয়ে কুসুম তৈরি করলে তা কখনই নরম ও রংহীন থলথলে হবে না। বরং সেটি সাদা ও শক্ত পদার্থে রূপ নিবে। অনলাইনে প্রচারিত ‘নকল ডিম তৈরি প্রণালীতে’ ‘ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড’ ডিমের কুসুম না, বরং খোলস তৈরিতে ব্যবহার করা হয় বলে দাবী করা হয়েছে।
৫) অনলাইনে বহুল প্রচারিত ‘সনাক্তকরণ পদ্ধতিতে’ কিংবা প্রতিবেদনের কৃষি বিজ্ঞানী – কেউই ‘বাল্বের আলোয় নকল ডিম সনাক্ত’ করতে পারার কথা বলে নি। এছাড়াও ঐ অংশটি ভালভাবে খেয়াল করলে দেখা যায় কেবল ডিম না, বরং বামপাশের পুরো ফুটেজই ডানপাশের ফুটেজটির চেয়ে তুলনামূলক অন্ধকার।

যমুনা নিউজের রিপোর্টের ফুটেজ থেকে
৬) একই দিনে এক চেষ্টায় মাত্র দুইটি ডিমের মধ্য থেকে একটি ‘নকল’ ডিম পাওয়া এবং ডিমের পাইকারি বাজারে গিয়ে ‘নকল’ ডিম পাচারের সাথে জড়িত একজনকে খুঁজে পাওয়ার ঘটনা কাকতালীয় হওয়াটা বেশ অস্বাভাবিক। এই ইন্টারভিউ এর ফুটেজটির পটভূমি সম্পূর্ণ প্রতিবেদকের ধারাভাষ্যের উপর নির্ভরশীল। কেননা, এই ফুটেজের শুরুর অংশ কেটে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদকের “বর্ডার দিয়ে আসে কেউ কিছু বলে না?” প্রশ্নের উত্তরে বোঝা যাচ্ছে না, তিনি প্রশ্নকর্তাকে আসলে কি নিয়ে আসার কথা বলছেন। এবং উত্তরদাতার প্রশ্নেও বুঝা যায় না, তিনি কি সাধারণ ডিম, নাকি ‘নকল’ ডিম, অথবা ডিম ছাড়া অন্য কিছুর ব্যাপারে উত্তর দিচ্ছেন।
৭) ২০০৪ সালে সর্বপ্রথম চীনে নকল ডিম তৈরি শুরু হয় কথাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে চীনের Xinhua News Agency-তে একটি আর্টিকেলে জনৈক ব্যক্তির তোলা একটি ‘নকল ও আসল ডিমের ছবি’ প্রকাশ করে।[6] ধারণা করা হয়, উৎপাদন না বরং এই ‘নকল’ ডিমের গুজবটি শুরু হয় তখন থেকেই। কেননা নকল ডিমের অস্তিত্ব এর আগে শোনা যায় নি। অথচ ছবিটি থেকে কোন ডিমটি আসল বা নকল তা সনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব এবং সেখানে প্রদত্ত তথ্যও অপর্যাপ্ত।

২০০৪ সালের ডিসেম্বরে চীনে একটি আর্টিকেলে জনৈক ব্যক্তির তোলা একটি ‘নকল ও আসল ডিমের ছবি’ প্রকাশ করে। ধারনা করা হয় এই থেকেই এই গুজবের শুরু হয়।
৮) ভারতে নকল ডিম পাওয়ার যতগুলো গুজব পাওয়া গিয়েছে তার প্রায় প্রতিটি গুজব বলে চিহ্নিত হয়েছে। এছাড়াও সেখানকার প্রতিবেদনগুলোও এই প্রতিবেদনের মত বিভিন্ন ইউটিউব ভিডিওর উপর ভিত্তি করে বানানো বলে দেখা যায়। ‘নকল ডিম বাংলাদেশে প্রবেশ করছে’ এই দাবীর প্রেক্ষাপটে প্রতিবেদক সুস্পষ্ট কোন প্রমাণ ছাড়া ঢালাওভাবে দাবীটি করেছেন।
৯) পরিশেষে প্রতিবেদক ‘নকল ডিমের’ ব্যাপকতা বাংলাদেশে এখনো ‘বেশী না’ বলেন। কিন্তু বাজারের কোটি কোটি ডিম থেকে দৈব চয়নের মাধ্যমে এক চেষ্টায় মাত্র দুইটি ডিম সংগ্রহ করে যদি সেসবের একটি নকল হিসেবে পাওয়া যায়, তাহলে গাণিতিকভাবে বাংলাদেশে ‘নকল ডিমের’ ব্যাপকতা কেবল বেশীই না, এটি রীতিমত প্রকট।
১০) প্রতিবেদনের শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজমা শাহীনের উক্তি মাঝ পর্যায় থেকে দেখানো হয় যেখানে তিনি বলেন, “এটা নিশ্চয় ক্ষতিকর। এটা হয়তো আরও ১০ বছর বা ২০ বছর গিয়ে বোঝা যাবে।” যা দেখলে মনে হবে তিনি ‘নকল’ ডিমের ব্যাপারে বলছেন। অথচ প্রতিবেদনে শেষের দিকে তার উক্তিতে বোঝা যায় তিনি মূলত মুরগীর খাদ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান বা মাত্রাতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করার প্রসঙ্গে কথাটি বলেছেন। পক্ষান্তরে, ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভিতে প্রচারিত অনুসন্ধানমূলক অনুষ্ঠান ‘তালাশ’-এ অধ্যাপক নাজমা শাহীনই প্রচারিত ‘নকল’ ডিমের ক’টি বৈশিষ্ট্যকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে এসবকে স্বাভাবিক বলে উল্লেখ করেন।[7]
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চ্যালেঞ্জ
এপ্রিল ২০১৭ তারিখে ‘বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ এই প্রতিবেদনটিকে চ্যালেঞ্জ করলে এপ্রিল ৭, ২০১৭ তারিখে ‘যমুনা নিউজ’ এই প্রেক্ষিতে আরেকটি রিপোর্ট করে। এই রিপোর্টেও পূর্বের রিপোর্টের ন্যায় প্রতিবেদকের ধারাভাষ্যের উপর নির্ভর করে পুরো সংবাদটি পরিবেশন করা হয়। শুরুতে সংবাদ পাঠক বলেন, “নকল বা প্লাস্টিক তো দূরের কথা, বাজারের একটি ডিমেও ভেজাল পাওয়া যায় নি – এমন দাবী নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের।” অথচ প্রতিবেদনের ফুটেজ অনুসারে কর্তৃপক্ষ কেবল ‘নকল’ ডিম-এর প্রমাণ পায় নি বলে দাবী করেছিল।
এই প্রতিবেদনে প্রতিবেদক বলেন, “জানা যায় সরবরাহের চেইনে গোঁড়ায় ভারত। সীমান্ত হয়ে অবৈধ পথে সেসব ঢোকার ছবিও তাই বলছে।” অথচ পূর্বের প্রতিবেদন থেকে প্রচারিত এই ফুটেজে কেবল নৌকা থেকে কিছু লোক ডিম নিয়ে ভ্যানে তুলছে দেখানো হয়। স্থানটি কোন সীমান্তে বা সেটির নাম কি তা উল্লেখ করা হয় নি। পূর্বের প্রতিবেদনেও এই ফুটেজ প্রচারে সময় সেটিকে কেবল ‘ডিমের পাইকারি’ বাজার বলে সম্বোধন করা হয়।
পুরো প্রতিবেদনে এই চ্যালেঞ্জের জন্য ‘বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে’ নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়। যদিও এই চ্যালেঞ্জের কোন যথাযথ উত্তর দিতে আলোচ্য প্রতিবেদক ব্যর্থ হন।
“চট্টগ্রামের পটিয়ায় ‘নকল ডিম’ জব্দ করে পুলিশ”
গত ২৮ জুলাই চট্টগ্রামের পটিয়া আদালতের এক বিচারক উপজেলা সদরের একটি দোকান থেকে এক ডজন ডিম কেনেন এবং বাসায় নিয়ে যাওয়া পর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারনে তিনি নকল ডিম সন্দেহ করে পুলিশকে অবহিত করেন। নকল সন্দেহে দোকানটি থেকে প্রায় দুই হাজার ডিম জব্দ করে পুলিশ। কিন্তু পটিয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে ডিমগুলো পরীক্ষার জন্য পাঠানো হলে প্রতিবেদনে সেসব ডিমকে ‘আসল’ ডিম হিসেবেই সনাক্ত করা হয়।[10]
‘নকল ডিম’ উৎপাদন ব্যবসায়িকভাবে কতটা লাভজনক?
অনলাইনে প্রচারিত নকল ডিম বানানোর প্রক্রিয়া বেশ শ্রম ও সময়সাধ্য। এই প্রক্রিয়ায় একজন ব্যক্তি ৮ ঘণ্টা কাজ করে ডিম তৈরি করতে পারে সর্বোচ্চ ৮০-১০০ টি। বড় পরিসরে এই হারে ডিম উৎপাদন করা কোনভাবেই ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক না, যেখানে বড় ফার্মগুলো আরও কম হারে শ্রমিক নিয়োগ করে আরও বেশী ডিম উৎপাদন করতে সক্ষম। বিশেষত চীনে ডিম উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ প্রায় সম্পূর্ন স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেশিন দ্বারা করা হয়।
লোকবল খরচের পাশাপাশি এই ডিমগুলো তৈরিতে যে যন্ত্রপাতি ও উপাদানগুলো ব্যবহার করতে হয়, সেসবের খরচ মিলে প্রতি ‘নকল’ ডিমের উৎপাদন ব্যয়, একটি সাধারণ ডিমের উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে যায়। আরও ব্যয় যোগ হবে যদি তা চীন থেকে অন্য দেশে রপ্তানি করতে হয়। এছাড়াও চীনের গণমাধ্যমেও আজ আবধি এই ধরণের বিশাল কারখানা উদ্ধার হয়েছে বলে কোন খবর পাওয়া যায় নি।
একজন ব্যবসায়ী শুধুমাত্র নকল ডিম বিক্রয়ের উদ্দেশ্যেই কেন নিজের ক্ষতি করে হলেও এরকম ডিম উৎপাদন করবে তা বেশ অস্পষ্ট।
‘নকল’ ডিম নাকি ‘নষ্ট’ ডিম?
ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভিতে প্রচারিত অনুসন্ধানমূলক অনুষ্ঠান ‘তালাশ’-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের পরিচালক, অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, “ডিম পুরনো হয়ে গেলে একসময় দেখবেন যে তা ভাঙ্গলে ডিমটির সাদা অংশ, নতুন ডিমের সাদা অংশ যেমন শক্ত (ঘন) থাকে, তেমন আর থাকে না। সেটি ছেড়ে দেয়। আবার ডিমের কুসুমটিও ভাঙ্গার পর চট করে ছড়িয়ে যায়। ডিমের ‘শেলফ লাইফ’ (Best Before Date) থেকে আরও পুরনো হয়ে গেলে ডিম ওরকম হয়ে যায়।”[7]
কিছু মাধ্যমে ‘নকল’ ডিম দেখতে ও স্বাদে সাধারণ ডিমের মত হয় বলে দাবী করলেও Glucolactone, Benzoic acid, Calcium Chloride, Cellulose, Alum, Amino Acid, Food coloring, Sodium alginate, Gelatin-এর মত উপাদান ব্যবহার করা হলে, তা রান্না করলে বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য কিংবা স্বাদ কিংবা গন্ধে সাধারণ ডিমের মত হবে কিংবা সম্পূর্ণ গন্ধহীন হবে – এটি অসম্ভব।
শুধুমাত্র মানবসৃষ্ট হলেই ডিমের অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য থাকবে – ব্যাপারটা ঠিক এমন না। মুরগীর খাবারে অতিরিক্ত হারে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান বা এন্টিবায়টিক মিশ্রণের ফলেও উৎপাদিত ডিমের এরকম অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য দেখা যেতে পারে। মুরগির অসুস্থতা থেকেও এমন হতে পারে। এছাড়া ডিম একটি নাজুক জৈবিক পদার্থ। প্রাকৃতিক কারণেই কিছু ডিমে অস্বাভাবিকতা থাকাটাই স্বাভাবিক। পাশাপাশি এটি সংরক্ষণের নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি আছে যা ডিমের গুণাবলী ঠিক রাখতে অবশ্যই পালনীয়। তাপমাত্রাও এক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাবক। খেয়াল করলে দেখা যায় এই বিষয়ক অধিকাংশ ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে গ্রীষ্মকালের দিকে।
নকল না হলে এসব কেন হয়?
ডিমের কিছু অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যা জানতে আমরা যোগাযোগ করি ‘বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট’ (BLRI)-এর পোল্ট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগের একজন বিজ্ঞানীর সাথে। তার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাগুলো নিম্নে দেওয়া হল―
১। ডিম ভাঙার পর সাদা অংশ ও কুসুম এক হয়ে যায়
স্বাভাবিক কক্ষ তাপমাত্রায় যদি ডিম বেশি দিন সংরক্ষণ করা হয়, তবে ডিমের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ গঠনে অনেক পরিবর্তন হয়। তখন ডিম ভাঙ্গলে ডিমের যে দুই ধরনের এ্যালবুমেন (থিক ও থিন) থাকে সেগুলো পানির মত হয়ে যায়, এবং ডিমের কুসুমও সামান্য আঘাতেই ছড়িয়ে পড়ে। বড় ডিম বা বয়স্ক মুরগীর ডিম তুলনামূলক বেশি দ্রুত পানির মত হয়ে যায়।

ডিমের ব্যবচ্ছেদ
২। ডিম ঝাঁকালে পানি গড়ানোর মতো শব্দ হয়
উপরে (১) বর্ণিত কারণেই এমন ডিম ঝাঁকালে পানি গড়ানোর মতো শব্দ হয়টা স্বাভাবিক। এমনকি ফ্রিজে 5-7 ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার উপর বেশি দিন সংরক্ষণ করলেও দেরিতে হলেও এমনটি হতে পারে।
৩। সাধারণ ডিমের চেয়ে বেশি ঝকঝকে
ডিমের খোলসে অসংখ্য ছোট ছোট ছিদ্র থাকে যা খালি চোখে দেখা যায় না। এই ছিদ্রগুলো দিয়ে ভিতরের গ্যাস বাইরে বের হতে পারে। এর কারণে ডিম আস্তে আস্তে নষ্ট হতে থাকে। যদি কোনভাবে এই ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া যায়, যেমন মোমের দ্রবণে অল্প সময় চুবিয়ে বা গ্লিসারিন বা অন্য কোন ক্যামিক্যাল দিয়ে হালকা করে প্রলেপ দিয়ে, তখন ভিতরের গ্যাস বের হতে পারে না এবং ডিমগুলো আরও বেশিদিন খোলা জায়গাতেই সংরক্ষণ করা যায়। অনেক ব্যবসায়ী এই কৌশলটি প্রয়োগ করে। ফলে ডিমগুলো বেশী চকচকে আর মসৃণ দেখাতে পারে।
৪। ডিমের খোলস বেশি শক্ত
ডিম বেশি দিন রেখে দিলে ডিমের খোলসের নিচেই একধরনের পাতলা পর্দা থাকে যা ‘ইনার মেমব্রেন’ নামে পরিচিত, সেটি প্লাস্টিকের মত শক্ত হতে থাকে। তখন ডিম ভাঙ্গতে গেলে বাইরের খোলসা বা ‘আউটার মেমব্রেন’ ভাঙ্গলেও ‘ইনার মেমব্রেন’ ভাঙ্গতে বা ছিঁড়তে চায় না, এটি দেখেই অনেকে ‘নকল ডিম’ বলে সন্দেহ করেন। স্বাভাবিক তাপমাত্রায়, তথা খোলা জায়গায় সংরক্ষণ করলে, বিশেষ করে আমাদের দেশে দোকানিরা যেভাবে করে থাকে, এমনটা হতে পারে। তবে ফ্রিজে রাখা ডিমও বেশিদিন সংরক্ষণ করলে এমন হয়।
৫। উত্তপ্ত পানিতে ডিম দিলেই তা ফেটে পড়ছে [8]
ডিম অনেকটা ক্ষুদ্র প্রেশার কুকারের মত। ডিমের ভিতরে সামান্য পরিমাণে আবদ্ধিত বাতাস থাকে। উত্তপ্ত পানিতে ডিম ছাড়া হলে, ভিতরের বাতাস বর্ধিত হতে থাকে এবং ডিমের খোলসের উপর চাপ সৃষ্টি করে। যার ফলে ডিম ফেটে যেতে পারে। এইভাবে ডিম ফেটে গেলে ডিমের ভেতরে সাদা অংশ বেড়িয়ে পানির সংস্পর্শে দুধের মত সাদা ও শক্ত হয়ে যায়। পাতলা ডিমের খোলস এই ধরণের ফেটে যাওয়া সম্ভাবনা বাড়ায়। তাই সিদ্ধ করার আগে ডিম ঠাণ্ডা পানিতে রেখে প্রস্তুত করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।
৬। ডিমের বিভিন্ন আকার
মুরগীর ডিম একটি জৈবিক বস্তু। আর তাই এটির আকার, রং ও আয়তন মুরগি থেকে মুরগি আলাদা হতেই পারে। পক্ষান্তরে তথাকথিত ‘নকল’ ডিম যেহেতু কৃত্রিমভাবে কারখানায় উৎপাদিত হয়, সেটিরই আকার ও আয়তন এক হওয়াটা আরও যুক্তিযুক্ত।
৭। ডিমের গন্ধ
ডিমের গন্ধ নির্ভর করে ‘Shelf life’-এর উপর, তাজা ডিমে প্রাকৃতিক কোন গন্ধ ছাড়া অন্য কোন গন্ধ থাকেই না বলা যায়। ডিমের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সালফার গ্যাসের মত ডিমের একটি গন্ধ হতে থাকে।
৮। কেন্ডিলিং ডিম
যেসব ডিম বাচ্চা ফুটানোর উদ্দেশে হ্যাচিং মেশিনে দেওয়া হয় সেসব ডিমকে কেন্ডিলিং ডিম বলে। নির্দিষ্ট সময়ের পর যদি দেখা যায়, ডিমগুলো থেকে বাচ্চা ফোটানো যাচ্ছে না, তখন ব্যবসায়ীরা এর মধ্য থেকে কিছু ডিম বাজারে বিক্রি করে দেয়। অনেক দিন হ্যাচিং মেশিনে থাকায় ডিমগুলোর ভেতরের বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন ঘটে এবং অতিরিক্ত গরমে ডিমের ভেতরের পানি বাষ্পীভূত হয়ে যায়।
আমাদের কথা
সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে বগুড়ার একটি সেমিনারে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন,[9]
“ডিম ও মুরগির মাংস নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে। এসব বিভ্রান্তি ভোক্তাদের মাঝে শঙ্কা-আতঙ্ক তৈরি করে। সামগ্রিকভাবে পোলট্রিশিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ কারণে পোলট্রিশিল্প-বিষয়ক প্রতিবেদন বা নকল ডিম কিংবা খামারের মুরগির মাংস নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির সময় গণমাধ্যমকর্মীদের সতর্কভাবে তথ্য সংগ্রহ করা দরকার।”
অথচ এইবছর এপ্রিল মাসে প্রথম আলো কোন প্রকার অনুসন্ধান ছাড়া একটি আর্টিকেলে বাংলাদেশের বাজারে ‘নকল’ ডিম আছে বলে উল্লেখ করে, যা মূলত বিদেশী কিছু আর্টিকেলের বঙ্গানুবাদ ছিলো মাত্র।
বাজারে ‘নকল’ ডিম বলে যদি কিছু থেকেও থাকে, তাহলেও এসব প্রচারিত রিপোর্টগুলোর প্রচার ও উপস্থাপন পদ্ধতি প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যায়। এসব প্রতিবেদনের প্রতিটিতে প্রকাশ পেয়েছে সংবাদ মাধ্যমগুলোর উদাসীনতা। নেতিবাচক খবরকে উত্তেজনাপূর্ণভাবে প্রচার করলেও যখন তা ভুল প্রমাণিত হয়, অধিকাংশ সংবাদ মাধ্যমগুলো তখন সত্য তো প্রচার দূরের কথা, ভুল স্বীকার করে দায়িত্বপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করে থাকে না। সংবাদমাধ্যম যেখানে জবাবদিহিতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে সেখানে তারাই প্রদর্শন করছে চরম দায়বদ্ধতাহীনতা। সবচেয়ে শোচনীয় বিষয় হচ্ছে ‘নকল’ ডিমের এই খবরগুলো প্রচার করেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত সংবাদ মাধ্যমগুলোর ক’টি।
বিশেষ ধন্যবাদ, মোঃ আতাউল গনি রাব্বানী, পোল্ট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগ, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট’ (BLRI)