যদিও বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে এতটা শোনা যায় না, তবে “দুধ এবং আনারস একসাথে বা পরপর খেলে বিষক্রিয়া হয়ে মারা যাবে” – ছোটবেলা থেকে এই কথাটি শুনে আসেনি এরকম মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে একেবারে নেই বললেই চলে। এই ভয়ে অনেকে যেদিন দুধ বা দুগ্ধজাত কিছু খান, সেদিন ভুলেও আনারস মুখে তোলেন না।
দুধের অন্যতম উপাদান হল ক্যাসিন (Casein) । দুধের সাথে যখন কোন অ্যাসিডিক পদার্থ মেশানো হয়, যেমন লেবু, আনারস, বা টক জাতীয় অন্য কোন ফল বা খাবার, তখন তা দুধকে ভেঙ্গে ক্যাসিন আলাদা করে ফেলে এবং দুধ পরিণত হয় ছানায়। [1] এমনকি মানবদেহে পাকস্থলীর মাঝেও এক বিশেষ প্রকার গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিড থাকে যা হজমে সহায়তা করে। দুধ পান করলে পাকস্থলীতে পৌঁছানোমাত্রই সেটি ক্যাসিন আলাদা করে দুধকে ছানায় পরিণত করে। এটি একটি স্বাভাবিক হজম প্রক্রিয়া, যা ছোটবড় সকলেরই হয়ে থাকে।[2]
দুধের মধ্যে আনারস মেশালে উপরে বর্ণিত কারণে দুধ জমাট বেধে ছানায় পরিণত হবে। যা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং আনারস ছাড়া অন্য যেকোনো টক জাতীয় খাবারের জন্যও প্রযোজ্য। কিন্তু এর কারণে এমন কোন বিষক্রিয়া তৈরি হয় না, যাতে মানুষ মারা যেতে পারে। এরকম ‘অপ্রক্রিয়াজাত’ ছানা এবং ‘আনারস মিশিয়ে’ বানানো ছানার মধ্যে গঠনগত কোন পার্থক্য নেই। তাই এমন ‘কাঁচা’ ছানা খেলে যেসব শারীরিক সমস্যা হতে পারে (বিশেষত গ্যাস্ট্রিকজনিত কোন সমস্যা থাকলে), আনারস ও দুধ একসাথে খেলেও ঠিক সেই রকমই সমস্যা হতে পারে। এছাড়া বিশেষ কোন সমস্যা বা বিষক্রিয়া হবে না।
তবে এখানে বলে রাখা দরকার, আনারস কিংবা দুধে কারো কারো এলার্জী থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে আনারস গ্রহণে কিংবা দুধ পানে বিরূপ শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এই জন্যই আলসার বা গ্যাস্ট্রিক বা ‘ল্যাক্টোজেন টলারেন্স’ কম এমন রোগীদেরকে দুধ পান করতে কিংবা বেশি পরিমাণে টক জাতীয় ফল খেতে নিরুৎসাহিত করা হয়। এই ধরণের পূর্ব শারীরিক অবস্থা না থাকলে, দুধ ও আনারস একসাথে খেলে আলাদা করে কোন স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। উল্লেখ্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আনারস ও দুধের তৈরি জনপ্রিয় বিভিন্ন পানীয় রয়েছে, যার মধ্যে ভাইফালা, বাবল টি পাইন্যাপল স্মুদিস, ওটাই, মিল্কশেক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব পানীয়তেও কোন বিষক্রিয়া হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় না।
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটির’ মেডিসিন বিভাগের প্রোফেসর ড. এ বি এম আব্দুল্লাহ এ বিষয় বলেন,[3]
“যদি কেউ আনারস ও দুধ একসাথে খায় তবে সে মারা যাবে – এমন ধারনাটি ভুল। এটি খাদ্যবিষয়ক কুসংস্কার বা ভ্রান্তধারনা।”
হলি মেডিকেল কলেজের মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের, ড. শাহ মোনেমের সাথে কথা বলা হলে তিনি বলেন,[3]
“আমি কখনো কোন মানুষকে দুধ ও আনারস একসাথে খেয়ে মারা যেতে দেখি নি। এটি একটি কুসংস্কার। অনেক সময় আমরা দুধ-আনারসের ডেসার্ট, কাস্টার্ড বা স্মুদি খেয়ে থাকি। কিন্তু এসব খেলে বিশেষ কোন সমস্যা হয় না।”
এপলো হসপিটালের প্রধান পুষ্টিবিদ তামান্না চৌধুরী বলেন,[3]
“দুধ ঠিক মত প্রক্রিয়াজাত না করলে, কিংবা অসম পরিমাণে আনারসের মিশ্রণে তা শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। যার ফলাফলে মৃত্যু না বরং পেট খারাপ হওয়া, বদ হজম কিংবা গ্যাস্ট্রিক জনিত সমস্যা হতে পারে।”
তবে ড. এ বি এম আব্দুল্লাহ, এই ধরণের সমস্যা এড়াতে ২-৩ ঘণ্টার পার্থক্যে দুধ ও আনারস খেতে পরামর্শ দেন এবং খালি পেটে আনারস খেতে নিরুৎসাহিত করেন।
“দুধ এবং আনারস একসাথে খেয়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু”
অক্টোবর ১০, ২০০৮ তারিখে ‘দি ডেইলি স্টার’ পত্রিকায় এই শিরোনামে একটি প্রকাশিত খবর এই গুজবের পালে হাওয়া লাগায় বেশ খানিকটাই। এমনকি কয়েকটি বৈশ্বিক গণমাধ্যমেও খবরটি দি ডেইলি স্টারের বরাত দিয়ে প্রচারিত হয়। মূল খবরে এক লাইনে লেখা আছে যে, পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন মৃত ব্যক্তি মদ্যপ অবস্থায় বাজি ধরে দুধ ও আনারস খান এবং কিছুক্ষণ পর অসুস্থ্যবোধ করেন। হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি মারা যান।
এখানে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, মদ একটি পরিত্যাজ্য পানীয় যেহেতু এতে কোন স্বাস্থ্যগুণ নেই বরং শরীরের জন্য ক্ষতিকর একাধিক উপাদান আছে। অপরিমিত মদ্যপান স্বাস্থ্যঝুকির বড় একটি কারণ এবং এ থেকে সৃষ্ট বিষক্রিয়ায় প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ মারা যায়। আনারস এবং দুধ একসাথে বা আগে-পরে খেলে কি হতে পারে তা বিস্তারিত পূর্বেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাই এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মদ্যপানই যে মূল প্রভাবক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দি ডেইলি স্টারের মত স্বনামধন্য একটি জাতীয় দৈনিকে অপরিণত এধরনের শিরোনামে (মদ্যপানকে উহ্য করে) খবর প্রকাশ খুবই বিভ্রান্তিকর উপস্থাপনা।