গুজবের উৎপত্তি
যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৮ সালের শেষের দিকে জনৈক ‘ড. এম আজাদ খান’ এর বরাত দিয়ে এই ধরণের ইমেইল বার্তা প্রচার শুরু হয় বিভিন্ন ওয়েবসাইটে। মূল লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘PIG FAT’। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক হালাল খাদ্য বিষয়ক কর্তৃপক্ষ, GMWA Food Guide এই বার্তাটিকে ‘প্রমানহীন দাবী’ বলে উল্লেখ করে এবং এটি প্রচারে বিরত থাকার পরামর্শ দেয়।[1]
বাংলাদেশে এই বার্তাটি বহুল প্রচারিত হয় জনৈক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ নুরুল হকের একটি বার্তার মাধ্যমে। এই বার্তাটি যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য না যেহেতু এটি প্রতিষ্ঠিত কোন গবেষণা না বরং একটি ‘চেইন মেইল’ এর উপর নির্ভর করে দাবীকৃত। এছাড়াও এই বার্তাটিতে তথ্য প্রদানেও কিছু ভুল আছে। ২০০৮ সালে প্রচারিত মূল ইমেইল বার্তা অনুসারে, ‘ড. এম আজাদ খান’ পাকিস্তান না, বরং যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষক।[1] তিনি যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মেডিকেল রিসার্চ ইন্সটিটিউটের কর্মকর্তা, ফ্রান্সের Departments of Food Administration-এর নয়। তার লেখার শিরোনাম ছিল ‘PIG FAT’ কিন্তু এই বার্তায় বলা হয় এটির শিরোনাম ‘Are we eating Pork?’।
এই বার্তায় উল্লেখিত সকল ই-নাম্বার সম্বলিত খাদ্যেই যে শূকরের মাংস বা চর্বি ব্যবহৃত হচ্ছে এমন দাবীটি সঠিক নয়। এমন কি এসবের কোনকোনটিতে প্রাণীজ উপাদান যেমন মাংস, চর্বি কিংবা হাড় নাও থাকতে পারে এবং বিকল্প হিসেবে উদ্ভিজ্জ উপাদানও ব্যবহার করা হতে পারে।
সত্যতা যাচাই
ই-নাম্বার (E-Number) দ্বারা প্যাকেটজাত খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহৃত নির্দিষ্ট কিছু ‘ফুড এডিটিভ’ নির্দেশ করা হয়। এটি ইউরোপিয়ান ইকোনোমিক কমিউনিটি (EEC) দ্বারা উদ্ভাবন করা হয় এবং পরবর্তীতে এই তালিকাটি সারা বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন শিল্প দ্বারা গৃহীত হয়।
‘E471’ ও ‘E476’ কোড খাদ্যে ব্যবহৃত বিশেষ প্রকার Fatty acids নির্দেশ করে যা ‘এমালসিফাইয়ার‘ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এমালসিফাইয়ার (Emulsifier) হচ্ছে কিছু বিশেষ প্রকার সংযোজিত খাদ্য উপাদান (Food additive) যা প্যাকেটজাত খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহার করা হয়, সেটির গুনগতমান দীর্ঘদিন ধরে রাখার জন্য। এটি বিশেষত চকলেট জাতীয় খাদ্যে ব্যবহার করা হয়, যাতে সেটিতে থাকা ফ্যাট ও প্রোটিন তাপমাত্রার কারণে সহজে গলে না যায়।
Mono-and Diglycerides of Fatty Acids (E471) ও Polyglycerol Esters of Polycondensed Esters of Caster Oil (E476) তৈরিতে উদ্ভিজ্জ তেল কিংবা পশু চর্বি ব্যবহার করা হয়।[2][3] কিন্তু এসবে শুধুমাত্র ‘শূকরের মাংসই’ ব্যবহার করা হয় এমন কোন দাবীর ভিত্তি নেই। বরং তুলনামূলক সাশ্রয়ী হওয়ায় ও নিরামিষভোজীদের চাপে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব উৎপাদনে উদ্ভিজ্জ তেল ব্যবহার করা হয়।
খান মোত্তাফিকুজ্জামান এর পোস্টটিতে ‘Safari’ চকলেটেও ‘E471’ ও ‘E476’ উপাদান পাওয়ার কথা দাবী করা হয়। তবে এই চকলেটের প্যাকেটের গায়ে উপাদান অংশে ‘Hydrogenerated vagetable fat used – contains trans fats’ কথাটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। যার অর্থ বুঝায় এটিতে ‘Animal Fat’ ব্যবহার করা হয়নি।
‘Muslim Consumer Group’ তাদের ওয়েবসাইটে এই দুইটিকে ‘মুশবুহ’ (হালাল নাকি হারাম তা সুস্পষ্ট না) বলে উল্লেখ করে, যেহেতু এই দুইটিতে পশু চর্বি ব্যবহার করা হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে।[4] মুসলমান ক্রেতাদের ক্ষেত্রে এই ধরণের পণ্য ব্যবহারে পরামর্শ হচ্ছে, ‘হালাল’ ট্যাগ অথবা ‘নিরামিষভোজীদের জন্য উপযোগী’ (Suitable for Vegetarian) ট্যাগ দেখে কিনা।
কোন নাম্বারগুলো সবসময়ই হারাম নির্দেশ করে?
তবে নিম্নের ই-নাম্বারগুলো হারাম উপাদান নির্দেশ করে যেহেতু তা সবসময়ই নিষিদ্ধ উপাদান থেকেই তৈরি করা হয়[5]—
E120, E124, E354, E951, E999
কোন কোন ইসলামি মতামতে বলা হয়, যেহেতু এসব ফুড এডেটিভ তৈরিতে একাধিক ধাপে প্রক্রিয়াকরণ করা হয়, উপাদান সংযোজন ও বিয়োজন করা হয় এবং এর ফলে নতুন আরেক উপাদান সৃষ্টি হয় (যেমন এলকোহল থেকে ভিনেগার তৈরি করা হয়), তাই কোনো কোনো এই ধরণের উপাদানের মূল উৎসের বিধান নতুন উৎসের জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে।[6]