অনুসন্ধান

প্রথম প্রকাশ:

২০০৩ সালের দিকে এই গুজব অনলাইনে হাজির হলেও এটি জনপ্রিয় হয় ২০০৬ সালে এবং ২০১৫ সালের দিকে এটি আধিপত্য বিস্তার করে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে এর প্রচলন শুরু হয় ২০১৬ সালের এপ্রিলের দিকে, যা কিছুদিন পরপর আবার ফিরে আসে।

বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত বার্তাটি মূলত ইংরেজিতে প্রচারিত গুজবের অনুবাদিত সংস্করণ মাত্র। মূল বার্তাটি প্রচারিত হওয়া শুরু করে চেইন ইমেইলের মাধ্যমে যা বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্টের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ‘স্ট্রোক’ একটি খুবই বিপদজনক শারীরিক অবস্থা এবং সাধারণভাবেই এই ব্যাপারে আমাদের শঙ্কা থাকলেও জ্ঞান খুবই সীমিত। তাই অনেকে ভয় ও উপকার করার উদ্দেশ্যেই এই গুজবটি প্রচার করে থাকলেও এই বার্তা দ্বারা প্রচারিত তথ্য কেবল ভিত্তিহীনই না, বরং বিপদজনকও বটে।

এই ধরণের চিকিৎসার বৈজ্ঞানিক কোন ভিত্তি নেই এবং কোন স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্তৃপক্ষ দ্বারা স্বীকৃত না।[1] হাসপাতালে না নিয়ে কালক্ষেপণ করে এই ধরণের চিকিৎসা প্রদান খুবই দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ হবে যেহেতু এতে রোগীর প্রকৃত সেবা পাওয়া আরও বিলম্বিত হবে। এর ফলস্বরুপ রোগী তার প্রাণ হারাতে পারে কিংবা স্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।

এই বার্তায় বলা হয় স্ট্রোকের রোগীকে কোথাও না সরাতে যেহেতু সরালে ‘মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ’ বিস্ফোরণ হতে পারে। মূল ইংরেজি বার্তায় আরও বলা হয়, এই প্রাথমিক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীকে স্বাভাবিক হতে সময় দিতে নয়তো তাড়াহুড়া করে ডাক্তারের কাছে নেওয়া হলে এ্যাম্বুলেন্সের ঝাঁকুনিতে ‘মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ’ বিস্ফোরণ হতে পারে। অথচ রোগীকে দ্রুত হাসপাতালস্থ না করা হলে এবং প্রকৃত চিকিৎসা না প্রদান করা হলে স্ট্রোকের ফলে ক্ষতির ঝুঁকি বাড়তেই থাকবে। এছাড়াও স্ট্রোকে সর্বোচ্চ রক্তক্ষরণ হতে পারে কিন্তু নড়াচড়ার কারণে রক্তনালী বিস্ফোরণ হয়ে থাকে না।[2] পাশাপাশি, এই ধরনের রোগী স্বাভাবিক হতে কয়েক ঘণ্টা লাগতে পারে এমন কি এই অপেক্ষায় জীবননাশও হতে পারে।

স্ট্রোকের প্রকারভেদ

স্ট্রোকের স্থায়ীকালের উপর ভিত্তি করে দুইভাবে ভাগ করা হয়। একিউট স্ট্রোক ও মাইনর স্ট্রোক।[2] একিউট স্ট্রোকের ফলাফল জীবননাশী কিংবা স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। এটিকে আবার প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে দুইভাগে ভাগ করা হয়।[3] একিউট স্ট্রোক হলে, একমিনিট ধরে সুচের ফুঁটায় আঙুল বা কান দিয়ে সামান্য কিছু রক্তক্ষরণের ফলে মস্তিষ্কের রক্ত জমাট খুলে (ischemic stroke) কিংবা মস্তিষ্কের রক্ত ক্ষরণ (hemorrhagic strokes) বন্ধ হয়ে স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার কোন যুক্তি নেই। তাই কিছুক্ষণ পর যদি রোগী আপনাআপনি সুস্থ হয়ে যায়, তাহলে তা সুচ দিয়ে ফুটো করার ফলে নয়, বরং রোগী মাইনর স্ট্রোক বা transient ischemic attack (TIA) এ আক্রান্ত হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে বলেই হয়েছে।

মাইনর স্ট্রোক মূলত সাময়িক কোন শারীরিক জটিলতার জন্য মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হলে ঘটে।[4] এতে রোগী কোনরূপ স্থায়ী ক্ষতি ছাড়া ২৪ ঘণ্টার মধ্যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তবে কোন ধরনের স্ট্রোকই কেবল উপসর্গ দেখে যথাযথ পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া নির্ণয় করা সম্ভব না। যেহেতু সব স্ট্রোকেই লক্ষণগুলো প্রায় একই এবং ভিন্ন শারীরিক সমস্যায়ও এইসব দেখা দিতে পারে।[2] তাই স্ট্রোক হচ্ছে কিংবা হয়েছে মনে হলে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা একান্ত জরুরি।

স্ট্রোকের লক্ষণ

স্ট্রোকের প্রধান (তবে অনন্য নয়, অন্য রোগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে এমন) উপসর্গ হচ্ছে―[4]

  • মুখ, হাত অথবা পায়ের আকস্মিক অবশতা বা দুর্বলতা, বিশেষত শরীরের যেকোন একপাশে।
  • আকস্মিক বিভ্রান্তি, কথার জড়তা, অথবা কথা বুঝায় সমস্যা হওয়া
  • এক বা উভয় চোখে না দেখতে পাওয়া
  • হাঁটতে সমস্যা হওয়া, মাথা ঘুরা কিংবা শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখতে না পারা
  • অজানা কারণে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করা

স্ট্রোক একটি মারাত্মক শারীরিক অবস্থা। এর কোন গৃহস্থলী প্রাথমিক চিকিৎসা নেই[5] স্ট্রোকের এসব উপসর্গ দেখা দিলে কোনভাবেই দেরি না করে রোগীকে নিকটস্থ হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে ভর্তি করাতে হবে এবং অভিজ্ঞ নিউরোলজিস্টের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

‘ডিজিটাল হাতুড়ে ডাক্তার’ সতর্কতা

‘মেডিকেল এডভাইস বিডি’ নামক একটি তথাকথিত মেডিকেল সাইট সরাসরি এই বার্তাটি হুবহু কপি-পেস্ট করে প্রচার করে। আবার ‘এই বার্তা’ নামক একটি নিউজপোর্টালে লেখাটির দৃশ্যমান পার্থক্য হচ্ছে, শিরোনামে ‘বাবা’ এর স্থানে ‘আম্মু’ লেখা। এসব ছাড়াও আরও অসংখ্য ওয়েবসাইট বা ফেইবুক পেইজে এই বার্তা কপি-পেস্ট করে প্রচার করা হয়। এ থেকে বুঝা যায়, এইধরনের সাইট কিংবা বিভিন্ন ডাক্তারের নামে পরিচালিত ফেইসবুক পেইজ ও ফেইক প্রোফাইল পরিচালকদের চিকিৎসা বিষয়ক কোন অভিজ্ঞতা নেই অথবা কোন অভিজ্ঞ ডাক্তারের সাথেও তাদের সম্পর্ক নেই। এদের ওয়েবসাইটের তথ্য উৎসগুলো হচ্ছে নামে-বেনামে পরিচালিত বিভিন্ন বিদেশী ওয়েবসাইট এবং এদের মূল উদ্দেশ্য স্বাস্থ্যসেবা না বরং মানুষের ভয়ভীতি ও অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এসব মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন।

অনলাইনে পাওয়া যে কোন তথ্য বিশেষত, স্বাস্থ্য ও খাদ্য বিষয়ক তথ্যগুলো নির্ভরযোগ্য উৎস ছাড়া বিশ্বাস করা থেকে বিরত থাকুন। এমনকি ডাক্তারের নাম উল্লেখ ছাড়া কোন ‘জনপ্রিয়’ পত্রিকাতেও এই বিষয়ক তথ্য ছাপালে এককথায় বিশ্বাস করবেন না। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং এরূপ তথ্য শেয়ারের পূর্বে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে নিন। আপনার অসচেতন আচরণ কারোর প্রাণনাশের কারণ যাতে না হয়।

পাদটীকা

তথ্যসূত্র

  1. Anahad O’connor. "The Claim: Pricking a Stroke Victim’s Fingers Can Help Delay Symptoms". The New York Times. (নভেম্বর ২১, ২০০৬).
  2. Dr. Steven P. Novella. "Needle Nonsense for Stroke". Neurologica Blog. (অক্টোবর ৩, ২০০৭).
  3. Jose Vega. "Acute Stroke and Sudden Strok". verywell. (জানুয়ারি ২৫, ২০১৭).
  4. "Transient Ischemic Attack (TIA) - Topic Overview". WebMD.
  5. "Stroke: First aid". Mayo Clinic. (নভেম্বর ১২, ২০১৪).

মন্তব্য