অনুসন্ধান

প্রথম প্রকাশ:

মে ২৮, ২০১৭ তারিখে নিউজ২৪ চ্যানেলে ‘ভাস্কর্য অপসারণ ও পুনস্থাপন’ প্রসঙ্গে প্রচারিত হয় চ্যানেলটির নিয়মিত টকশো ‘জনতন্ত্র গণতন্ত্র’ এর আলোচিত পর্বটি। টকশোটিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাক্তন উপদেষ্টা ও ‘আইন ও শালিস কেন্দ্র’-এর নির্বাহী পরিচালক, সুলতানা কামালসহ আরও উপস্থিত ছিলেন, হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা মুফতি সাখওয়াত হোসাইন, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার এবং আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য অপু উকিল।

এই টকশোর জের ধরেই গত জুন ২ তারিখ, শুক্রবার, হেফাজতে ইসলাম এক সভায় অভিযোগ আনে সুলতানা কামালের বিরুদ্ধে। হেফাজতের নেতৃবৃন্দ দাবী করেন যে টকশোতে সুলতানা কামাল বলেছেন – “ভাস্কর্য থাকতে না দিলে মসজিদ থাকতে দেওয়া হবে না।”

Position Not Set

টকশোটির আলোচিত অংশটির কথোপকথন হুবহু তুলে ধরা হলো―

সুলতানা: “আমার কথা হলও যে, সেটা (ভাস্কর্যটি) যদি মূর্তিও হয়, সেটাও সেখানে থাকলে অসুবিধা কি? মুসলমানরা সেটা পূজা না করলেই হলও।”

সাখওয়াত: “হ্যাঁ, অসুবিধা আছে।”

সুলতানা: “না, কোন অসুবিধা নাই।”

সাখওয়াত: “এটা (ভাস্কর্যটি থাকা) আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী।”

সুলতানা: “মোটেই না।”

সাখওয়াত: “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত।”

সুলতানা: “তার মানে কি? হিন্দুদের কিছুই থাকবে না?”

সাখওয়াত: “সব থাকবে।”

সুলতানা: “তাহলে (সাখাওয়াত হোসেইনের যুক্তি অনুযায়ী) তো মসজিদও থাকার কথা না (যেহেতু সেটিও একটি সম্প্রদায়ের প্রতীক)।”

সাখওয়াত:(ভাস্কর্যটি রাখা যাবে না) কারণ এই মূর্তিটা একটা সম্প্রদায়ের।”

সুলতানা: “হ্যাঁ, অবশ্যই।”

সাখওয়াত: আদালত প্রাঙ্গণের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কোন সম্প্রদায়ের প্রতীক থাকতে পারে না।”

সুলতানা: “নিশ্চয়ই (সম্প্রদায়ের প্রতীক) থাকতে পারে।”

সাখওয়াত: “যদি সেটা (সম্প্রদায়ের প্রতীক) থাকে তাহলে সেটা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী হবে।”

সুলতানা: “তাহলে (মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী হলে) ওখানে ঈদগাহ আছে কেন? ওখানে মসজিদ আছে কেন? (সেসবও তো একটি সম্প্রদায়ের প্রতীক)

ইমরান: “আচ্ছা, আপনি যদি এখন হিন্দুদের মন্দির দেখলেই আর প্যাগোডা দেখলেই, চার্চ দেখলেই যদি আপনি মনে করেন সেটি সাম্প্রদায়িকতা তাহলে তো হলও না।”

সুলতানা: “সেখানে যদি মসজিদ থাকতে পারে, মূর্তি থাকতে পারবে না কেন?”

সাখওয়াত: “অবশ্যই থাকবে। মসজিদ থাকবে…”

সুলতানা: (কথার মাঝখানে) “তাহলে মূর্তি থাকতে পারবে না কেন?”

সাখওয়াত: “…মুসলমানরা মসজিদে গিয়ে এবাদত বন্দেগি করবে।”

সুলতানা: “তাহলে হিন্দুরাও করবে।”

সাখওয়াত: “হিন্দুরা তাদের মতো করে পূজা করবে।”

ইমরান: “আচ্ছা, আপনি বলেন আর কোনটা কোনটা মুর্তি বাংলাদেশে? এটা জানতে চাই।”

সাখওয়াত: “আমি আগে শেষ করি। হেফাজতে ইসলাম শুধু…হেফাজতে ইসলাম না, ইসলাম এই জায়গায় তার বক্তব্য স্পষ্ট-কোনও ধর্মের ওপর আঘাত হোক, ইসলাম এটা বরদাশত করে না।”


এই কথোপকথনে এটি সুস্পষ্ট যে সুলতানা কামাল “ভাস্কর্য না থাকলে বাংলাদেশে মসজিদও থাকার দরকার নাই” এমন কোন মন্তব্য বা দাবী করেন নি। ‘আদালত প্রাঙ্গণে কোন সম্প্রদায়ের প্রতীক থাকলে তা স্বাধীনতা চেতনা বিরোধী’ – মুফতি সাখওয়াত হোসাইনের এমন একটি যুক্তি প্রদান করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সুলতানা কামালের পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেন যে সাম্প্রদায়িক প্রতীক থাকলে তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী হলে, আদালত প্রাঙ্গণে ঈদ্গাহ বা মসজিদও থাকার কথা না, যেহেতু সেসবও একটি সম্প্রদায়ের প্রতীক। এই অনুষ্ঠানটিতে কোন বক্তাই ‘দরকার নেই’, ‘থাকা যাবে না’ -এই ধরণের কোন বাক্যই ব্যবহার করে নি।

অপরদিকে আবার কেউ কেউ দাবীটিকে বদলীয়ে ‘মন্দির না থাকলে, মসজিদ থাকার দরকার নাই’ বলেও প্রচার করে। অনুষ্ঠানটির শেষ দিকে ‘বিভিন্ন স্থানে মন্দির ভাঙ্গার ঘটনার’ প্রসঙ্গ ছাড়া, পুরো টকশোতে মন্দির বিষয়ক কোন মন্তব্য কোন বক্তাই করেন নি।

মে ২৮ তারিখে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার হলেও এই উক্তিটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় হেফাজত ইসলাম-এর নেতৃবৃন্দের দাবীর পর। এই দাবীর জের ধরে ফেইসবুক ও ইউটিউবে তৈরি করা হয় অগণিত বিদ্বেষমূলক পোস্ট যার কোন কোনটিতে সুলতানা কামালকে ‘দেশ থেকে বের করে দেওয়ার’, ‘গ্রেফতার করার’ দাবী জানানো হয়। এছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যমে তাকে হত্যার হুমকিও প্রদান করা হয়।

আমাদের কথা

এই ঘটনাটি বাংলাদেশের একটি ভয়ঙ্কর বাস্তবতার নির্দেশ দেয়। একটি কথোপকথন, যা সম্পূর্ন ভিডিও সহকারে রেকর্ড করা ও সবার জন্য উন্মুক্ত, তা দিয়েও কত সহজে আমাদের দেশে গুজব রটিয়ে মানুষকে বিশ্বাস করানো যায়। শুধু বিশ্বাসই না, সেই বিশ্বাসকে মোড় দেওয়া যায় বিদ্বেষ ও সংঘাতে। দৃষ্টিসীমাতে সত্য থাকলেও আবেগকে কাজে লাগিয়ে কোন বিশেষ পরিশ্রম ছাড়াই সেটির ব্যাপারেও অন্ধত্ব সৃষ্টি করা সম্ভব।

আর এই উত্তেজনার সুযোগ নেয় বিবেকবর্জিত কিছু স্বার্থানেসি গোষ্ঠী, যারা নিউজ পোর্টাল ও সংবাদের নাম করে বিদ্বেষকে টাকায় রূপান্তর করছে। তাদের এই ধরনের কাজের জন্য প্রাণ হারাতে হতে পারে নির্দোষীদের এবং বাস্তবতা এই যে, তারা হয়তো প্রাণ হারানোর ঘটনাটিকেও সংবাদ বানিয়ে সেটিকে রুপান্তর করবে টাকায়।

সতর্ক থাকুন, দায়িত্বের সাথে শেয়ার করুন। কারণ একসময় গুজবের শিকার হতে পারেন আপনিও।

পাদটীকা

তথ্যসূত্র

  1. জনতন্ত্র গণতন্ত্র. "ভাস্কর্য অপসারণ ও পুনস্থাপন". নিউজ২৪ চ্যানেলে. (মে ২৮, ২০১৭).

মন্তব্য

দাবীটি প্রচারণার সময়কাল