জাতিসংঘের ‘স্বল্পোন্নত দেশ’ (Least Developed Country বা LDC) বিভাগীকরণের মাধ্যমে সেসকল দেশকে সনাক্ত করা হয়, যারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক থেকে তুলনামূলকভাবে অনগ্রসর। এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহকে জাতিসংঘসহ অন্যান্য দাতা সংস্থাগুলো বিভিন্নভাবে সহযোগিতা প্রদান করে থাকে; যেমন, কম সুদে ঋণ প্রদান, আন্তর্জাতিক বাজারে অগ্রাধিকার দেওয়া, ঋণ পরিশোধের শর্তসমূহ নমনীয় রাখা ইত্যাদি। এসব সহযোগিতার মাধ্যমে এসকল অনগ্রসর দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।
জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিপিডি) তাদের ত্রি-বার্ষিক রিভিউর মাধ্যমে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকা দেশগুলোর অর্থনৈতিক সূচকসমূহ পর্যালোচনা করে। এই রিভিউর মাধ্যমে কোন দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের (Graduation) যোগ্যতা অর্জন করেছে তা নির্ধারণ করা হয়।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০১৮ সালে সিপিডির ২০তম রিভিউতে প্রথমবারের মত বাংলাদেশ এই তালিকা থেকে উত্তরণের সূচকগুলো পূরণ করতে সক্ষম হয়। সূচকগুলো হচ্ছে―[1]
১. অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচক ৩২ পয়েন্ট বা তার নিচে থাকতে হবে। (বাংলাদেশ: ২৫ পয়েন্ট দশমিক ২)
২. মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ বা এর বেশি পয়েন্ট পেতে হবে। (বাংলাদেশ: ৭৩ দশমিক ২)
৩. মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার থাকতে হবে। (বাংলাদেশ: ১ হাজার ২৭৪ ডলার)
এসব সূচকসমূহের নূন্যতম দুটি পূরণ করতে পারলেই কোন দেশকে প্রথমবারের মত রিভিউ এর যোগ্য ধরা হয়। সেখানে বাংলাদেশ ৩টি সূচকেই উত্তীর্ণ হয়েছে।
তালিকা থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য, প্রথমবারে উত্তীর্ণ হওয়ার তিন বছর পরের রিভিউতেও (বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০২১ সালের রিভিউতে) উত্তীর্ণ হতে হবে। পাশাপাশি পার করতে হবে আরও একাধিক সুনির্দিষ্ট ধাপ।[2] এই বছর বাংলাদেশ এই ধাপগুলোর প্রথমটি পার করেছে মাত্র।
২০১৮ সালের রিভিউতে এবছর মোট ৫টি দেশ উত্তীর্ণ হয়েছে। দেশগুলো হচ্ছে বোটসওয়ানা, কেবো ভের্ড, ইকুয়েটরিয়াল গিনি, মালদ্বীপ ও সামোয়া। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এখনো উত্তীর্ণ করা হয়নি।[3]

প্রথমবার একটি দেশ যোগ্যতার সূচকগুলো উত্তীর্ণ করলে, তিন বছর পরের ত্রি-বার্ষিকী রিভিউতেও পুনরায় উত্তীর্ণ হতে হবে। বাংলাদেশ শুধু প্রথম ধাপ পার করেছে মাত্র। সূত্র: জাতিসংঘের ওয়েবসাইট।
কিভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তীর্ণ করা হয়?
কোন দেশ প্রথমবার সূচকগুলো পূরণের পর, তিন বছর পরে দ্বিতীয়বার সূচকগুলো পূরণ করলে, দেশটির তৎকালীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে কমিটি উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্য বলে সিদ্ধান্ত প্রদান করে থাকে।
কমিটির সুপারিশের পর, জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল (ECOSOC) এই বিষয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করে। এই সিদ্ধান্তে কোন দেশকে উত্তরণ করা হলে, পরবর্তী ত্রি-বার্ষিক রিভিউতে, অর্থাৎ, প্রথমবার সূচকগুলো পূরণের ৬ষ্ঠ বছরে, একটি দেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। অর্থাৎ, সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি হতে কমপক্ষে ৬ বছর সময় নিতে পারে। অপরদিকে উল্লেখিত সূচকগুলো পূরণের পরও, যদি কমিটির বিবেচনায় কোন দেশ পাশ না করে, তবে এই সময় ৬ বছরেরও বেশি হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, এই বছর নেপাল ও তিমোর-লেস্ট দেশ দুটি উত্তরণের সূচক দ্বিতীয়বারের মত পূরণ করলেও দেশ দুটিকে উত্তীর্ণ করার সুপারিশ করা হয়নি।
বিভ্রান্তির শুরু যেভাবে
কোন দেশ প্রথমবার নির্ধারিত সূচকগুলো পূরণ করলে, জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভাগ (DESA) তা আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটিকে জানায়। এবছর ১৬ মার্চ নিউইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসুদের কাছে একটি চিঠি হস্তান্তরের মাধ্যমে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে অবগত করেন সিপিডি সেক্রেটারিয়েটের প্রধান, রোলান্ড মোলেরাস।[4][5] কিছু বাংলাদেশী মিডিয়া প্রথম ধাপের এই আনুষ্ঠানিকতাকে ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের যোগ্য হয়েছে বাংলাদেশ’-এমন শিরোনামে সংবাদ পরিবেশন করে।

সরকারি এক সভার ব্যানারে লেখা হয়, “স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ উপলক্ষে…” অথচ বাংলাদেশকে এখনো উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ করা হয়নি।
মিডিয়ার ভুল ব্যাখ্যার পাশাপাশি সরকারীভাবেও দাবী করা হয় যে, বাংলাদেশ ‘স্বল্পোন্নত’ দেশ হতে ‘উন্নয়নশীল’ দেশে উত্তরণ করেছে। এই উপলক্ষে ২২ মার্চ সারা দেশব্যাপী সরকারের পক্ষ থেকে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক এই উপলক্ষে ৭০ টাকার স্মারক নোট প্রকাশেরও ঘোষণা প্রদান করে।[6]
প্রথমবারের মত যোগ্যতার সূচক অর্জন খুব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলেও, ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ‘বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ করেছে’ এমন দাবী করা সকল অর্থেই ভুল। এছাড়াও উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হলে বাংলাদেশ অনেক অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করবে না যা বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে পেয়ে আসছে। তাই উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ শুধুমাত্র অর্জনই না, বরং এক প্রকার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগ্রহণও। এই কারণেই জাতিসংঘ সময়সাপেক্ষ পর্যালোচনার মাধ্যমে একটি দেশের উত্তরণের যোগ্যতা পরিমাপ করে থাকে।